রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ‘পাপের সাম্রাজ্য’ ভেঙে দিলো পুলিশ
উত্তরার অভিজাত হোটেলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড

রাজধানীর অন্যতম অভিজাত এলাকা উত্তরায় অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে সাত নারীসহ অন্তত ১৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ‘হোয়াইট গ্র্যান্ড ইন’ নামক একটি আবাসিক হোটেলে এ অভিযান চালানো হয়।
অভিযানকালে হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে মাদকদ্রব্য, সেক্স টয়, কনডম, লুব্রিকেন্ট, ভিডিও রেকর্ডিং যন্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়েছে।
অভিযান ও পুলিশের বক্তব্য
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন,
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, ওই হোটেলটিতে দীর্ঘদিন ধরে স্পা সেন্টারের আড়ালে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে আসছে। আমরা অভিযান চালিয়ে ১৫ জনকে আটক করেছি। তদন্ত চলছে।
ওসি আরও জানান, এ ধরনের অপকর্ম বন্ধে পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কাজ করছে এবং নাগরিকদের সহযোগিতা কামনা করছে।
গোপন ‘পাপরাজ্য’ ও রাজনৈতিক যোগসূত্র
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা এবং দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—
গ্র্যান্ড ইন হোটেলটি দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়ে আসছিলো। হোটেলটির আশেপাশে অন্তত ৩টি ছোট হোটেল ও রেস্ট হাউসেও একই ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলো একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
আরও পড়ুন <<>> বিকৃত যৌনাচার ‘ফেমডম সেশন’ নিয়ে আলোড়ন, ২ নারী গ্রেফতার
স্থানীয়দের অভিযোগ— এখানে রাতে পরিচিত মুখগুলোর ভিড় লেগেই থাকে। দামি গাড়ি এসে নামে, সিকিউরিটির লোকেরা কারও সামনে হোটেলের দরজা খুলে না। স্পা নামের একটা প্রতারণার মোড়কে চলছে দেহব্যবসা।
স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, যেখানে পুলিশি টহল থাকার কথা, সেখানে রীতিমতো ফ্লাইয়ার ছাপিয়ে ভিজিটিং কার্ড বিলি হয়। নতুন লোক এলে ওদের টার্গেট করা হয়।
আর্থসামাজিক দিক ও অপরাধচক্রের চরিত্র
সূত্র জানায়, এ হোটেল ও সংশ্লিষ্ট চক্রের মাসিক আয় প্রায় ১৫–২০ লাখ টাকা। চক্রটি ৩–৫ হাজার টাকায় একেকটি ‘সেবা প্যাকেজ’ অফার করে। এ প্যাকেজের অংশ হিসেবে নারীদের দিয়ে মাদক সেবন করানো, ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল, এবং নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের কৌশলে নতুন খদ্দের টানা— এসবই চক্রের কৌশল।
প্রশ্ন উঠছে— এত বড় চক্র যদি এতদিন ধরে চলে, তাহলে পুলিশের দৃষ্টিতে আসেনি কেনো? না কি কেউ ‘ওপরে’ থেকে ঢাল হয়েছিলো?
রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন— হোটেলটির মালিকানায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাই, যিনি নিজে একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।
অভিযানে ধরা পড়া কয়েকজনের ফোনে পাওয়া গেছে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড, ভিজিটিং কার্ড ও ছবি।
রাজনৈতিক সুরক্ষা পাওয়ায় পুলিশ দীর্ঘদিন এড়িয়ে গেছে—এমন অভিযোগ বহুবার স্থানীয়রা করলেও এখন পর্যন্ত সেসব অভিযোগে কার্যকর ব্যবস্থা হয়নি।
জনগণের প্রশ্ন: এটাই কি শেষ অভিযান?
ঘটনাটিকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নেটিজেনরা বলছেন— পুলিশ কি শুধু ভিডিও ফুটেজ নিয়ে থেমে যাবে? নাকি গডফাদারদেরও ধরবে? চাঁদাবাজি, রাজনীতি আর দেহব্যবসা মিশে তৈরি হয়েছে ‘পাপের রাজনীতি’!
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সালেহীন রফিক বলেন— এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ঢাকায় চালু থাকা অন্তত ২৫টির বেশি হোটেল বা স্পা সেন্টার একইভাবে অপরাধে জড়িত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এ সিন্ডিকেট এক মাসেই ভেঙে দেয়া সম্ভব।
উত্তরার ‘পাপের সাম্রাজ্য’ বন্ধ হবে কবে?
উত্তরার হোটেল গ্র্যান্ড ইনে এ অভিযান নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু জনগণের চাওয়া, শুধু মুখচোরা গ্রাহক নয়—মূল গডফাদার, তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, অবৈধ অর্থের উৎস—সব কিছু প্রকাশ্যে আনা হোক। আর নয়তো একে ধামাচাপা দিয়ে নতুন নামে আবার চালু হবে ‘নতুন হোটেল গ্র্যান্ড ইন’—যেখানে সমাজ, রাষ্ট্র ও নৈতিকতা হারাবে প্রতিদিন।
সবার দেশ/কেএম