Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ০০:০৭, ১ মে ২০২৫

আপডেট: ০০:১৬, ১ মে ২০২৫

শ্রমিকের ঘামে গড়া দেশ অধিকারেই হোক রক্ষা

শ্রমিকের ঘামে গড়া দেশ অধিকারেই হোক রক্ষা
ছবি: সবার দেশ

আজ ১ মে, বিশ্ব শ্রম দিবস বা ঐতিহাসিক মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেটের আন্দোলনে শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে রক্ত দিয়েছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন। সে আত্মদান আজো বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে মে দিবস এখনো শুধুই আনুষ্ঠানিকতা, ব্যানার, পোস্টার আর কিছু নেতামুখী বাণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। যে ন্যায্যতা, যে মর্যাদার স্বপ্ন তারা শতবছর ধরে লালন করেছে, আজও তার বাস্তব প্রতিফলন খুবই ক্ষীণ।

শ্রমিকের ঘামই শিল্পের ভিত্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রমিকদের ঘামে গড়া। অর্থাৎ, আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে নিযুক্ত ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক। এছাড়াও চা বাগান, নির্মাণ শিল্প, কৃষি খাতে শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম।

কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, এ শ্রমিকরা যাদের ঘামে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার পূর্ণ হয়, তাদেরই অধিকাংশকেই দুইবেলা পেট ভরে খেতে হয় চিন্তা করে। ঈদ আসে, উৎসব আসে—কিন্তু বহু শ্রমিক তখনো বকেয়া বেতন-ভাতার জন্য কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিকে ধনকুবের মালিকের প্রাসাদ, অন্যদিকে শ্রমিক পরিবারের অনাহার-অর্ধাহার; একদিকে বিলাসী বিদেশ সফর, অন্যদিকে অজস্র শ্রমিক পরিবারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমিছিল—এ কেমন উন্নয়ন?

 স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হলেও বাংলাদেশে এখনও এমন একটি দৃশ্য বিরাজমান যেখানে শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরি সময়মতো পায় না, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয় না, সামাজিক নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। অথচ শ্রমিক ছাড়া শিল্প নেই, শিল্প ছাড়া উন্নয়ন নেই। এ মৌল সত্য ভুলে গিয়ে একতরফা মুনাফার চিন্তা করলেই সমাজে অসমতা, হিংসা ও শোষণ গভীর হয়।

বৈশ্বিক তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর ন্যূনতম মজুরি মানদণ্ডের দিক থেকে বাংলাদেশ আজও পিছিয়ে। আফ্রিকার বহু অনুন্নত দেশের তুলনায়ও আমাদের শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি মজুরি কম। কেনিয়ার একজন গার্মেন্টস শ্রমিক যেখানে গড়ে মাসে ১৫০-২০০ ডলার পান, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিক পান মাত্র ৮৫-১০০ ডলার। অথচ আমাদের উৎপাদন দক্ষতা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত। সমস্যা কোথায়? মূলত: ব্যবস্থাপনাগত উদাসীনতা, তদারকির ঘাটতি এবং লোভী মালিকচক্রের সীমাহীন লালসা।

শুধু কম মজুরি নয়, বাংলাদেশে বহু কারখানায় শ্রমিকদের নেই কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, নেই প্রসূতি ছুটি, নেই মেডিকেল সুবিধা, নেই শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকর স্বাধীনতা। সরকারি পর্যায়ে তদারকি বা জবাবদিহি ব্যবস্থা নামেমাত্র, শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দায়িত্বে যারা, তারাই অনেক সময় মালিকপক্ষের লবি করে যান।

মে দিবস কি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা?

প্রতি বছর মে দিবস এলেই সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘শ্রমিক-মালিক একতা’, ‘শ্রমিকের অধিকার’, ‘সাম্য ও ন্যায্যতা’-র বুলি শোনা যায়। মঞ্চে চলে ঢক্কানিনাদ, কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায় না। দিবসটি অনেকটা হয়ে উঠেছে মেকি আনুষ্ঠানিকতার প্রতীক। অথচ এ দিবস হবার কথা ছিলো শ্রমিকের সুরক্ষা ও মর্যাদার জন্য নতুন পদক্ষেপ ঘোষণার দিন, হবার কথা ছিলো মালিক ও সরকারের কাছে জবাবদিহিতার মুহূর্ত।

একটি বাস্তবভিত্তিক প্রতিশ্রুতি চাই

আজকের এ মে দিবসে আমাদের জাতীয় দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য বাস্তব ও টেকসই নীতিমালা গ্রহণ করা। শুধু বক্তৃতা নয়, চাই কার্যকর পরিবর্তনের পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপের মধ্যে থাকতে পারে:

  • জাতীয় মজুরি বোর্ডকে কার্যকর করা: প্রতিটি শিল্পখাতে বাস্তবভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও তা নিয়মিত আপডেটের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। শুধু ঘোষণাই নয়, প্রয়োগ নিশ্চিতে চাই কঠোর মনিটরিং।
  • শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা: প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, বিশ্রামের সময়, স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা মান বজায় রাখতে হবে। আগুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত জরুরি নির্গমনের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • বেতন পরিশোধে সরকারি তদারকি: সরকারি শ্রম তদারকি সংস্থার সনদ ছাড়া কোনও কারখানাকে ব্যাংক থেকে অর্থছাড় বা রফতানি সুবিধা না দেয়ার বিধান চালু করা উচিত। আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিশ্চিত করুন, তারপর মালিকের উন্নয়ন।
  • শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী: বেকারত্বকালীন ভাতা, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ, সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা এবং পেনশন চালু করতে হবে ধাপে ধাপে। এটি এককালীন খরচ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার বিনিয়োগ।
  • স্বাধীন ও সক্রিয় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের নিশ্চয়তা: প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে গঠিত ইউনিয়ন ছাড়া শ্রমিক স্বার্থরক্ষা হয় না। ইউনিয়নের কাজ বাধাগ্রস্ত করলে মালিকপক্ষকে আইনের আওতায় আনার নজির স্থাপন জরুরি।

শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক হোক অংশীদারিত্বের

শ্রমিক আর মালিক কোনো পক্ষ বিপক্ষ নয়। একজন বিনিয়োগ করেন, আরেকজন শ্রম দেন—এ যুগলবন্দীতেই শিল্প চলে। তাই এ সম্পর্ক হোক পরিবারসুলভ; যেখানে শ্রমিকের প্রতি থাকবে দায়িত্ব, মালিকের প্রতি থাকবে শ্রদ্ধা। শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করে যে শিল্প দাঁড়ায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, বরং বিক্ষোভ, অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনায় ধসে পড়ে।

আরও পড়ুন <<>> ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি: বাংলাদেশে এক নতুন দিগন্ত

আমরা দেখেছি, যেখানে মালিকপক্ষ শ্রমিককে সম্মান দিয়েছে, সময়মতো প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছে, সেখানে শ্রমিকরাও প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে। এমনকি উৎপাদনে মালিককে পেছনে ফেলে নিজের দায় নিজে নিয়েছে। তাই আজ দরকার সে অংশীদারিত্বমূলক মনোভাব।

মে দিবস কোনো শ্লোগান নয়, কোনো ব্যানার-বক্তৃতার দিন নয়—এটি অধিকার ও দায়িত্বের পুনর্ব্যাখ্যার দিন। এ দিনে যদি আমরা শ্রমিকের চোখে চোখ রেখে বলতে পারি, ‘তুমি আমার সহযোগী, শোষিত নয়’—তবেই দিবসটি সফল।

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রাকে টেকসই করতে হলে, আমাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে ‘শ্রমিক-কল্যাণকে’। শ্রমিককে অবহেলা করে উন্নয়নের ইমারত দাঁড় করানো মানে বালির ওপর প্রাসাদ নির্মাণ—যা যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে।

আসুন, এ মে দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি—শ্রমিক আর মালিক নয় দুই মেরু, আমরা সবাই একটিই পরিবার; একটি উন্নয়নমুখী, ন্যায্যতাভিত্তিক, মানবিক বাংলাদেশের পরিবার।

১ মে ২০২৫
সম্পাদক

সম্পর্কিত বিষয়: