Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ০০:১৪, ৩ মে ২০২৫

আপডেট: ০৩:৪৫, ৩ মে ২০২৫

নিষিদ্ধ বয়ান

রাজনীতিবিদদের ‘জনগণ’ কারা? এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হওয়া জরুরি

রাজনীতিবিদদের ‘জনগণ’ কারা? এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হওয়া জরুরি
ছবি: সবার দেশ

‘জনগণ বলেছে’, ‘জনগণ চায় না’, ‘জনগণ রুখে দেবে’—বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই শব্দগুলোর ব্যবহারে যেন এক অলৌকিক ছদ্মাবরণ রয়েছে। প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা ও দল তাদের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে এবং নিজেদের সিদ্ধান্তকে বৈধতা দিতে যখন তখন ‘জনগণ’-এর নামে কথা বলে থাকেন। অথচ সে জনগণ কে, কী চায়, কবে চেয়েছে—এ প্রশ্নগুলো করলে রাজনীতিকদের মুখে তালা পড়ে যায়।

এ ‘জনগণ’ বাস্তবতার মাটি ছুঁয়ে থাকা কোনো শ্রেণি নয়; বরং রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থের তোলপাড়ে তৈরি একটি কাল্পনিক অস্তিত্ব, যার কাজ একটাই—ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে ব্যবহৃত হওয়া।

জনগণের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামি, জাসদ, এলডিপি, এনসিপি কিংবা ‘গণ অধিকার পরিষদ’—প্রত্যেকেই তাদের কার্যক্রমে ‘জনগণ’-এর নামে কার্যত নিজেদের স্বার্থকেই বৈধতা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ বলে, ‘জনগণ উন্নয়ন চায়’; বিএনপি বলে, ‘জনগণ ভোটাধিকার চায়’; জামায়াত বলে, ‘জনগণ ইসলাম চায়’; আর নতুন তরুণ-ভোট ব্যাংকের শিকারিরাও বলে, ‘জনগণ পরিবর্তন চায়’। কিন্তু বাস্তবে এ জনগণকে কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি তারা আসলে কী চায়।

স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দলগুলোর যারাই ক্ষমতায় গেছে, নিজেদের মতো করে সংবিধান বদলেছে, আবার জনগণের নামে এসব বৈধও করে ফেলেছে!

বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যে কোনো জাতীয় নির্বাচন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া হয়েছে—তা স্বীকার করতে এখন আর কোনো বিবেকবান মানুষের দ্বিধা নেই। পতিত আওয়ামী লীগ ভোটবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে, বিএনপি আন্দোলনের নামে শুধু ফেসবুকে গর্জেছে, রাজপথে নয়। তাদের আন্দোলনের উস্যুগুলোও ছিলো দলীয় ভিত্তিক, সেজন্য জনসম্পৃক্ততা পায়নি। এ দুই দলই জনগণের নামে একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। কিন্তু জনগণের সুনির্দিষ্ট অংশগ্রহণ কোথায়?

‘জনগণ’ শুধুই প্রতিশ্রুতি গ্রহণের যন্ত্র?

প্রতিটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে প্রতিশ্রুতির পাহাড়। কিন্তু জয়ী হওয়ার পর সে ইশতেহারগুলো হয় পুড়িয়ে ফেলা হয়, নয়তো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলা হয়—পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন এসেছে। প্রশ্ন হলো, কোন পরিস্থিতি? জনগণকে জিজ্ঞেস করে কী পরিস্থিতি বিবেচনায় আনা হয়েছে?

আসলে জনগণ এখানে শুধু ভোটদাতা নয়, চুপ থাকা করদাতা, নিপীড়নের শিকার, শোষণের উৎস। তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গণতন্ত্রের আলঙ্কারিক উপাদান মাত্র। যাদের নিকট থেকে সমর্থন চাওয়া হয় শুধু নির্বাচনের আগে, কিন্তু নির্বাচনের পরে তাদের চাওয়া-পাওয়া, ন্যায্য অধিকার আর গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেউই সাড়া দেন না।

দলীয় ‘গণতন্ত্র’ মানেই নেতৃত্বের হস্তচালিত জনমত

আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি—উভয় দলের মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে কোনো অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। দলের ভেতরে বিরোধিতার কোনো জায়গা নেই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, আছে কেবল এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত, আর সেটি নিতে গিয়ে কখনো কখনও ‘গণতন্ত্রের’ দোহাই দেয়া হয়। জাসদ, এলডিপি বা জাতীয় পার্টি এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই ক্ষমতার কাছে নতজানু। তারা কখনও ‘গণতন্ত্রের নামে সহাবস্থান’ আবার কখনও ‘জাতীয় ঐক্য’-র নামে ক্ষমতার গলি খুঁজে বেড়ায়।

এমনকি গণ অধিকার পরিষদের মতো নবীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীও শুরুর দিনগুলোতে কিছুটা আলাদা বার্তা দিলেও পরে দলগত অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পড়ে তাদের তথাকথিত জনগণের প্রতিনিধিত্বও হাস্যকর পর্যায়ে নেমে আসে। যে কোনও দুর্বল বিরোধীদল ক্ষমতা না পেয়ে আন্দোলনের নামে জনগণকে ব্যবহার করে, আর যে দল ক্ষমতায় থাকে সে ব্যবহার করে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ‘জনগণ’ কারা?

  • জনগণ কি রাজনীতিবিদদের লুটপাট করতে বলেছে?  
  • জনগণ কি বলেছে গুম করো, খুন করো, ধর্ষণ করো, রাষ্ট্র লুট করে খাও?
  • না! কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা ঠিক সেটাই করে, আর দায় চাপায় সে অলিখিত ‘জনগণের’ কাঁধে।

জনগণের নামে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন বৈধ করা

জনগণের নিরাপত্তার নামে বাংলাদেশে কী ভয়াবহ নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হয়েছে তা এক কলামে বলার মতো নয়। খুনি, ধর্ষক, দালাল, দস্যু ও লুটেরা—সবাই রাজনৈতিক ছাতার তলে নিরাপদ। আর জনগণের নামে তারা হয়ে ওঠে রক্ষাকর্তা। গুম করা হয় রাজনৈতিক কর্মীকে, কিন্তু বলা হয়—‘জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে কিছুকিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’

যেমন ২০১৩ সালে ৫ মে হেফাজতের আন্দোলনে শতশত মাদ্রাসা ছাত্র, লেম-ওলামা ও সাধারণ জনগণের ওপর পুলিশ ও সরকার সমর্থিত গুন্ডাবাহিনীর হামলার পর, তা নিয়ে বিচার তো দূরের কথা, উল্টো হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও বিশিষ্টজনের নামে মামলা করা হয়। জেলে পুরা হয়। আলেম-ওলামাদের আসামি করে করা মামলাগুলো রাজনীতিকদের একটি মুখোশ উন্মোচন করে—যেখানে জনগণের স্বার্থ নয়, বরং ক্ষমতার রক্ষার্থে বিরোধিতাকে দমন করাই মূল উদ্দেশ্য।

‘জনগণ’ শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, মানসিকতার পরিচয়

বলা হয়ে থাকে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণ হলো এক শ্রেণিবিশেষ ‘ভোটার’ মাত্র, যাদের চিন্তা, মতামত, ক্ষোভ—কিছুই রাজনৈতিক নেতাদের কাছে মূল্য রাখে না যদি তা তাদের স্বার্থে না যায়। নেতারা তাদের সমর্থক ছাড়া আর কাউকেই ‘জনগণ’ বলে স্বীকার করেন না। তাই এক দলের নেতা বলবে, ‘জনগণ বিএনপিকে চায় না’, অপর দল বলবে, ‘জনগণ আওয়ামী লীগকে চায়’। খুনি হাসিনাও জনগণের দোহাই দিয়ে কতকিছু করেছেন, কতকিছু বলেছেন। জনগণকে জিজ্ঞেস করেই যদি তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন, তবে জনগণ তাকে তাড়িয়ে দিলো কেনো?’ প্রশ্ন হলো ‘জনগণ’ যদি আওয়ামী লীগকেই চাইবে, তবে তাদের সেট করা বিচারপতি থেকে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে গেলো কোন ‘জনগণ’র ভয়ে?

এখানে জনগণের মানসিকতা, তাদের মৌলিক অধিকার, স্বপ্ন বা সংকট—এসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। জনগণ নামক ‘মেঘের রাজ্য’ কেবল ছায়া হয়ে থাকে রাজনীতিকদের মুখের বুলি হিসেবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিধি বদল দরকার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সত্য অনিবার্য হয়ে উঠছে—নতুন প্রজন্ম আর ‘জনগণ’ শব্দের ভেক দেখে থেমে থাকবে না। মানুষ এখন জানতে চায়, ‘জনগণ’ বলে যে দোহাই দেয়া হয়, তার ভিত্তি কী? কোন মতামত যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়? শুধু দলীয় সভায় গালি দিয়ে বা ক্ষমতাবানদের তোষণে জনগণের মুখোশ পরানো যাবে না।

নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উচিত সত্যিকার অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের চর্চা করা, জনগণের মধ্যে নিয়মিত মতামত গ্রহণ করা, ওরকম কাল্পনিক সিদ্ধান্ত নয়—বাস্তব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কথাবলা।

আজ যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘রাজনীতিবিদদের জনগণ কারা?’—তাহলে উত্তর আসবে না, কারণ এ দেশের রাজনীতিতে জনগণ কখনও ‘নির্বাচনের পর’ ছিলেন না। তারা ছিলেন লাঠির মুখে, ভোট ডাকাতির সামনে, উন্নয়নের নামে প্রকল্পের চুরির নিচে, গুম-খুনের আতঙ্কে বা মিথ্যা মামলার আসামির তালিকায়। তাই জনগণকে নিয়ে যতই বুলি কপচানো হোক না কেনো, তারা একদিন জিজ্ঞেস করবেই—আমাকে জিজ্ঞেস না করেই এত বড় বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নেন আপনি?

যেদিন এ প্রশ্ন রাজনৈতিক পরিসরে সশব্দে উঠবে, সেদিনই ‘জনগণ’ সত্যিকার অর্থে জনগণ হয়ে উঠবে—আর নয় ছদ্মবেশী রাজনৈতিক ঢাল।

লেখক ও সংবাদকর্মী