Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:৩৮, ৪ মে ২০২৫

প্রবন্ধ

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর
ছবি: সবার দেশ

(৬ষ্ঠ পর্ব)

আপনি ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামিক চিন্তাবিদ ও গবেষকদের বই পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথ আর শরৎবাবুর বই পড়ে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাওয়া আর আদার বেপারী জাহাজের খবর করা একই কথা।
জ্ঞান আর যুক্তি কখনো ধর্মের চার দেয়ালের ভেতর আটকে রাখা যায় না। ন্যায়-নীতি ও চিরন্তন সত্য সব ধর্মের বেলায়ই এক ও অভিন্ন। ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে যারা ধর্মসহ ন্যায়-নীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করে তারা হয়তো ইতিহাস জানে না নয়তো বিশ্ব বিচ্ছিন্ন গোঁড়া ও গোঁয়ার।

আস্তে বলুন, এ দেশ রাজতন্ত্রের দেশ। রাজতন্ত্রের দেশে রাজাই অল- ইন-অল। আরবের মাটিতে বাঙালি স্বভাব পরিহার করে জান্নাতুল বাকীর বিষয়ে শুনুন- এক সময় মসজিদে নববী ও বাকীর মাঝে হারাতুল আগওয়াই নামের জনবসতি ছিল- জনবসতিতে হারামের খাদেমরা বাস করতেন। মসজিদ ও বাকী স¤প্রসারণের প্রয়োজনে সবাইকে তুলে দিয়ে মসজিদ আর বাকী এক সীমানায় করে দিয়েছে। সউদী আমলেই বাকীর স¤প্রসারণ ঘটে দু'বার। বাকীয়ে আম্মাত, বাকীয়ে গারকা নামে নতুন নতুন নামকরণ করা হয় বর্ধিত অংশের। ১৩৯০ হিজরীতে পাথরের দেয়ালসহ সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয় যাতে বর্ষাকালে দাফন কাজে কারো অসুবিধা না হয়। এ দেশে কারণে অকারণে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করা নিষিদ্ধ। তাছাড়া সাধারণ মানুষ মনে করে এ দেশ রাজার। রাজার দেশে আমরা বসবাস করি। অপরাপর দেশের মানুষ গণতন্ত্রের নামে যা করছে তা থেকে এ দেশের রাজা রাজতন্ত্রের নামে যা করে তা কোনো অংশেই খারাপ নয়। আমার আপনার চেয়ে এ দেশে ওলামা-এলেমও কম নেই।

-আরবের মাটিতে আলেম কোনো কালেই কম ছিল না। যখন জুম্মার নামাযে খোতবার ভাষা পরিবর্তন করে ইমামদের উপর গালি-ভর্ৎসনা শুরু হয়েছিল তখনও আলেমগণ ছিল, প্রজাপীড়ক ত্রিশ লক্ষ নকল হাদিস আলেমগণের হাত দিয়েই বের হয়েছিল এবং সুফি-সাধনা নিষিদ্ধসহ সমাধি নিশ্চিহ্ন করার যুক্তি আলেমগণই দিয়ে গেছেন। কিন্তু সবকিছুর মূলে ছিল ‘যেই লাউ সেই কদুর খেলা'।
-যেই লাউ সেই কদুর খেলা আবার কোনটি?
- ঐ যে বললে, এক সময় মসজিদ ও বাকীর মাঝখানে হারাতুল আগওয়াই নামে এক জনবসতি ছিল। 

জনবসতিতে মসজিদের খাদেমগণ বাস করতেন। এ খাদেমগণের মধ্যেই ছিল বানু হাসিমের লোকজন। বানু হাসিমের লোকেরাই কিনা কারবালা হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করে বৈরী হয়েছিল উমাইয়াদের। অঙ্গীকার ভঙ্গসহ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ করায় বৈরী হয়েছিল আববাসীয়দের। তারা সরকারের কোপানল থেকে বাঁচার জন্য অনেকে দেশ ত্যাগ করে। অবশিষ্টদের সবাই রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। একান্ত জীবন ধারণের জন্য জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য, দর্শন, আধ্যাত্ম সাধনা, ইমামতিসহ মসজিদের সেবা খেদমতের কাজ শুরু করে। জ্ঞানচর্চা থেকে অর্জিত অতি সামান্য আয় দিয়ে সামান্য আশ্রয়ে তাঁরা অত্যন্ত সাদা-মাটা জীবন ধারণ করতেন। মসজিদ স¤প্রসারণের মতো মহৎ কাজের জন্য বলী হয়ে গেলো তাদের সামান্য আশ্রয়টুকুও। স¤প্রসারিত অংশে শুধু নামাযের জায়গাই হয়নি, হয়েছে বেশকিছু বিপণী বিতানও। এক ঢিলে তিন পাখি মারার কাজটি বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়ে গেলো। গণতন্ত্রের দেশে গলা ফাটিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে বুকের জ্বালা মুখে আনা যায়। এর ফলে, মনের কোনো জ্বালাই বুকে জমাট বাঁধতে পারে না। এ দেশে যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা পাথরের টুকরোগুলো দেখে কখনো কখনো কি মনে হয় জানো?
- কি মনে হয়?
- কখনো কখনো মনে হয় একেকটি পাথর একেকটি মানুষের জমাট বাঁধা হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। প্রকাশের সুযোগ না পেয়ে বুকের ভেতর জমতে থাকা হাজার বছরের জ্বালা-জমাট বেঁধে কঠিন পাথরে পরিণত হয়ে রয়েছে। অনুক‚ল পরিবেশে দ্রবীভ‚ত হওয়ার সুযোগ পেলে পাথরগলা পানিতে জুলুমকারীরে তথতেতাউসও ভেসে যেতে পারে।
- কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সম্পূর্ণ অনুচিত।

কিছু কিছু বিষয় অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তার মধ্যে ইসলাম ধর্ম অন্যতম। ইসলামকে আন্তর্জাতিক মানের বললেও খাটো করা হয়। কারণ, ইসলামের বীজ প্রথম আরবের মাটিতে রোপিত হলেও বর্তমানে মহীরুহের আকার ধারণ করে মহাবিশ্বের মহাকাশ ছাড়িয়ে ছায়াপথ পাড় হয়ে আল্লাহর স্বর্গলোকে পৌঁছে গেছে। ইসলামের বিশাল মহীরুহের স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াতলে শুধু ভ‚লোকের জ্বীন ইন্‌সান আশ্রয় গ্রহণ করেনি- আশ্রয় গ্রহণ করেছে স্রষ্টার সৃষ্ট সকল প্রাণী ও পদার্থ। তাই কেউ এই মহীরুহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি পাতায় আঁচড় দিলেও সকলের প্রতিবাদ করা উচিত। নয়তো সংস্কারের নামে যুগে যুগে ছাটাই হয়ে বিন্দু বিন্দু রূপান্তরের ফলে এমন রূপ ধারণ করতে পারে যে রূপ থেকে আদি ও আসল রূপ খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে।
আপনার জানা থাকা দরকার, এমন কোনো কাজ কিংবা কথা যা করা বা বলার কারণে মুসলমানে মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে, তা করা বা বলা ধর্মে বারণ আছে। কারণ, মুসলমানে মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম। এর মাঝেই আবার ফতোয়ার হাতিয়ার হাতে তুলে নিলে! কখনও কখনও কোনো কোনো ফতোয়াকে হাতিয়ার করে কেউ কেউ ‘নিজের জন্য লীলাখেলা পরের জন্য পাপ' হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, এ বিষয়টি তোমারও জানা থাকা দরকার। এমন কোনো কথা বা কাজ যা সম্পন্ন করা বা না করার কারণে শুধু মুসলমান নয়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা শুধু জঘন্য পাপই নয় নোংরা এবং অমার্জনীয় অপরাধও।

ইসলামের এই চমৎকার বিধানগুলো ব্যবহারকারীর কারণে বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে। মূল্যবান আইন এবং চমৎকার ফতোয়ার ধারক ও বাহকেরা যখন আইন এবং ফতোয়াকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তখনই আইন এবং ফতোয়া মূল্যহীন হয়ে পড়ে। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.)-এর সময়কাল পর্যন্ত ইসলামের ৭২টি মতভেদ প্রকাশিত হয়েছিল। মতভেদগুলো যারা সৃজন করেছে তোমাদের মতো ফতোয়াবাজদের দ্বারা তারা তিরস্কৃত না হয়ে বরং পুরস্কৃত হয়েছে। এখনও তাদের নামের আগে ‘হযরত’ এবং পরে ‘রহমতউল্লাহ...’ লেখা হয়ে থাকে। আর কারবালার নির্মম হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে হালে ‘মিলাদ মার্ফিল বা নবী করিম (স.)-এর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে মিলাদ বা আলোচনা বেদায়াত, এবং ‘এবাদত ও দোয়ার সময় নবী করিম (স.)-কে উপলক্ষ করে কিছু চাওয়া শির্ক’ মর্মে ফতোয়া প্রচার শুরু করেছে তা কতটুকু সঙ্গত তা আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। ‘মিলাদে রাসূল (স.) হাজির আছেন মনে করে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান করা শিরকের পর্যায়ে পড়ে’ এ কথা বলে আমাদের হৃদয় থেকে সরিয়ে নবী করিম (স.)-কে কোথায় নিয়ে ঠাঁই দিতে চায় তাও বলার ক্ষমতা আমার নেই। তবে ইসলামের ইতিহাস পাঠ করে যা বলতে পারি তাহলো তখন এক শ্রেণীর স্বার্থোন্মত্ত লোকেরা ইসলামের সুন্দর নিয়ম-নীতিগুলোর সাথে নিজস্ব স্বার্থ যুক্ত করে শাসকের পোষ্য কাকমোল্লাদের হাতে তুলে দিত। শাসকের পোষ্য কাকমোল্লারা শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে ফতোয়ার হাতিয়ারে রূপান্তর করে ছড়িয়ে দিতো রাজ্যময়। এখন ফতোয়ার অমোঘ হাতিয়ার রয়েছে তোমাদের মতো কাটমোল্লাদের হতে। কাক-মোল্লাদের হাতে ফতোয়ার ব্যবহার পদ্ধতিও চমৎকর। তোমরা তোমাদের স্বার্থে সামান্য ছায়াপাত সৃষ্টি হতে দেখলেই ফতোয়া নামক অমোঘ হাতিয়ারটি হাতে তুলে নাও। যখন আঘাত হানা হয় তখন ফতোয়া জারি হয় না- আঘাত সহ্য করতে না পেরে যখন চিৎকার করে উঠি তখন চিৎকারের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হতে শুরু হয়।

- শুনুন, হজ্জব্রত পালন করতে এসেছেন হজ্জব্রত পালন করে চলে যান। এ দেশের সাহায্য না পেলে আমাদের চলে না, তাদের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়বে সে খেয়াল আছে? শেষে কিন্তুমুখের খাছিয়তে ঝুলনা বেয়ে ফেন পড়বে। যার ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই তার পক্ষে কিল দেখার গোসাই হওয়া ঠিক নয়।

তোমার কথা হলো, দুধ দেওয়া গাই লাথি দিলেও ভালো। তারা বহির্বিশ্বে তাদের আদর্শ স্থাপনের উদ্দেশ্যে মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য যতো টাকা দান করে তার কানাকড়িও আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির পেছনে দান করে না। তাদের অনুদানে শিক্ষাপ্রাপ্তগণ একদিন তাদেরই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার সৈনিক হয়ে উঠবে। তারা আমাদের মানুষ বানানোর জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার দান করে। তাদের অনুদানে আমরা মানুষ কতটুকু হতে পারছি বলতে পারি না। তবে মায়ের কোলে বাস করে মাতৃভাষা ভুলতে শুরু করেছি তা বলতে পারি। তাদের কেউ কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলায় সাইনবোর্ড টানাতে গিয়ে একটি শব্দের মধ্যে তিনটি ভুল করে থাকে। তারপরেও ধর্মীয় শিক্ষাদান করতে গিয়ে আমাদের যোগ্যতায় ঘাটতি পড়ে না। তাই আবারও বলতে হচ্ছে- এখন আর ইসলাম আরবদের একার সম্পত্তি নয়। ইসলাম ধর্ম একদিন আরব ভ‚মি থেকে বিকশিত হলেও তা এখন আর আরব ভ‚মির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে আরবে যে পরিমাণ মুসলমান আছে তার কয়েক'শ গুণ বেশি মুসলমান রয়েছে আরবের বাইরে। বলতে গেলে, বিশ্বের মোট মুসলমানের তুলনায় আরবের মুসলিম সংখ্যা খুবই নগণ্য। সে কারণে 'ইসলাম' এখন আর কোনো দেশ বা জাতির ব্যক্তিগত বিষয় সম্পদ নয়। কেউ ইচ্ছে করলেই ইসলামের নিয়ম-কানুন ও রীতি-নীতি স্বেচ্ছাচারভাবে পরিবর্তন করতে পারে না। নবী করিম (স.)সহ তাঁর পরিবারের লোকজন (আহলে বাইয়েত)দের সমাধির সম্মানের সাথে মুসলিম জাহানের সমস্ত মুসলমানের ধর্মীয় অনুভ‚তি ও চেতনা জড়িত রয়েছে। মহান স্রষ্টার মহাসৃষ্টির মহৎ কল্যাণের উদ্দেশ্যে যা করা দরকার তা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। (চলবে,,,)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক