কেএনএফ-এর ইউনিফর্ম রাষ্ট্রবিরোধী অর্থায়নের এক বিপজ্জনক সঙ্কেত

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার রিংভো অ্যাপারেলস নামক একটি পোশাক কারখানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে প্রায় ২০ হাজার ৩০০টি ইউনিফর্ম জব্দ করা হয়, যেগুলোর গন্তব্য ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। 

এ ঘটনায় কারখানার মালিকসহ তিনজনকে গ্রেফতার ও একজন পাহাড়ি নেতাকে মামলায় আসামি করা হয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতি এবং সমাজের আইনগত কাঠামোর জন্য ই ঘটনা এক ভয়াবহ বার্তা বহন করে।

KNF: একটি সশস্ত্র রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন-

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ বিগত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা মূলত বান্দরবান ও রাঙামাটির ৯টি উপজেলাকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক ‘স্বশাসিত রাষ্ট্র’ গঠনের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। KNF-র বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, হত্যা ও ইসলামি জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো—সংগঠনটি একাধিকবার ব্যাংক ডাকাতির মতো উগ্র অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে, যার ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে KNF শুধু একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নয়, বরং একটি সংগঠিত সশস্ত্র জঙ্গি কাঠামো।

শিল্প কারখানার ছদ্মবেশে সন্ত্রাসে অর্থায়ন-

চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় KNF-এর ইউনিফর্ম তৈরির ঘটনা আমাদের সামনে এক নতুন চিত্র উপস্থাপন করে—জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ এখন শুধুমাত্র পাহাড়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এটি শহরের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে ছদ্মবেশে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলছে। এখানে দুই কোটি টাকার লেনদেন শুধু অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, বরং রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ। এটি একটি অ্যালার্মিং ট্রেন্ড, যেখানে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বৈধ খাতকে অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও নিরবতা-

ঘটনার তদন্তে নগর গোয়েন্দা পুলিশ তৎপর ভূমিকা রাখলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ নীরবতা যদি প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা কিংবা রাজনৈতিক চাপের ইঙ্গিত দেয়, তবে তা ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের পথ সুগম করে দিতে পারে।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় প্রভাব-

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত। সেখানে KNF-এর মতো একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের অবৈধ অনুপ্রবেশ এই শিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি মনে করেন যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত জঙ্গিবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদে অর্থায়নের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।

রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে-

একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যখন শহরের ব্যবসায়িক খাতে অনুপ্রবেশ করে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালায়, তখন তা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—বরং রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, সামাজিক সংহতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি বড় ধরনের ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে। KNF-এর এ তৎপরতা ভবিষ্যতে বৃহত্তর জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

চট্টগ্রামে KNF-এর ইউনিফর্ম তৈরির ঘটনাটি একটি সতর্কবার্তা। এটি স্পষ্ট করে দেয় যে পাহাড়ের সন্ত্রাস এখন সমতলের বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোকেও গ্রাস করছে। এ ঘটনা শুধু অপরাধ নয়—এটি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার দ্রুত, স্বচ্ছ ও কঠোর প্রতিকারের প্রয়োজন। রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করে এ সন্ত্রাসী অর্থায়ন চক্র ভেঙে ফেলতে হবে—না হলে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

লেখক: ওমর ফারুক
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।