বেঙ্গল গ্রুপের মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত মামলা

ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম, তার ভাই ও পুত্রের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি মামলা দায়ের করেছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' গোপন করে নিজের ভাইয়ের মালিকানাধীন জমি কোম্পানির অর্থে অতিমূল্যে কেনা হয়, যার প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয় জাল দলিল ও মিথ্যা তথ্য।
কৌশলী ক্ষমতার অপব্যবহার
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার ২৩৯ নং গণিপুর মৌজায় একটি নির্মাণাধীন বাণিজ্যিক ভবনের ৬০০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ও ৫টি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৬.৬৫ কোটি টাকায় জমি কেনে। জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন মোরশেদ আলমের ভাই মো. জসিম উদ্দিন। কিন্তু ‘সম্পৃক্ততার’ বিষয়টি গোপন করতে, জমির বিক্রয়-ক্ষমতা ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’র মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয় মোরশেদ আলমের পুত্র সাইফুল আলমের কাছে, যিনি তখন বেঙ্গল কনসেপ্ট অ্যান্ড হোল্ডিংস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মিথ্যা প্রত্যয়ন ও জাল কাগজপত্র
আইন অনুযায়ী, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর অনুমোদনের পূর্বশর্ত ছিলো যে, প্রস্তাবিত বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বীমা কোম্পানির কোনো পরিচালক বা উদ্যোক্তার স্বার্থ-সম্পৃক্ততা থাকবে না। কিন্তু ন্যাশনাল লাইফ-এর তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল মোহাম্মদ আবু নাসের কর্তৃক আইডিআরএ বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনে মিথ্যা প্রত্যয়ন দেয়া হয়—যেখানে বলা হয়, বিক্রেতা কোম্পানির সাথে আমাদের কোন পরিচালক বা উদ্যোক্তার সম্পৃক্ততা নেই।
আর্র পড়ুন <<>> বদনা থেকে বেদনা: সাবেক এমপি মোরশেদ ধরা
এছাড়া, জমির উচ্চ মূল্য দেখিয়ে জমি বিক্রির জন্য তৈরি হয় তিনটি জাল মূল্য নির্ধারণী প্রতিবেদন। এগুলোর মধ্যে প্রতি বর্গফুটের মূল্য ধরা হয় ১১,৭০০, ১১,৫০০ ও ১১,৬০০ টাকা। অথচ জমিটি ছিলো অবিভক্ত, অচিহ্নিত এবং নির্মাণাধীন ভবনের অংশবিশেষ।
তিন সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
জমি বিক্রয়ের অর্থ—৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা—বেঙ্গল কনসেপ্ট অ্যান্ড হোল্ডিংস লিমিটেড-এর গুলশান শাখায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। উক্ত অ্যাকাউন্টের সিগনেটরি হিসেবে নাম ছিলো মোরশেদ আলম, তার ভাই জসিম উদ্দিন এবং ছেলে সাইফুল আলমের। অর্থাৎ, পুরো লেনদেনেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন পরিবারের তিন সদস্য।
দুদকের মামলা ও আইনি পদক্ষেপ
দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলার নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১-এ এজাহার দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৪০৯ (অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ), ৪২০ (প্রতারণা), ৪৬৭/৪৭১ (জাল দলিল সৃষ্টি ও ব্যবহার) এবং ১০৯ (সহায়তা) ধারায় মামলা।
অঅরও পড়ুন <<>> বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ কারাগারে
প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তর
একজন দুদক কর্মকর্তার ভাষায়, এটি নিছক জমি কেনা নয়। এটি প্রতিষ্ঠানের অর্থকে পারিবারিক লেনদেনে পরিণত করে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহারের এক নগ্ন দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা পর্যন্ত প্রতারিত হয়েছে। এসব অপরাধ অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ এবং বীমা খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্বচ্ছতা ও হিসাবরক্ষণে অধিকতর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে প্রয়োজন স্বাধীন নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা—যাতে ভবিষ্যতে এমন আত্মীয়তাসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যায়।
সবার দেশ/কেএম