সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না চামড়া, পেছন ছাড়েনি সিন্ডিকেট

চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে সরকার বাড়তি দাম ঘোষণা করলেও বাজারে তার প্রতিফলন নেই। বাস্তবে গরুর কাঁচা চামড়া আগের মতোই কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ছাগলের চামড়ার প্রতি আগ্রহ ছিলো আরও কম।

শনিবার (৭ জুন) ঈদুল আজহার দিন রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্সল্যাব ও পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

মাঠের বাস্তবতা

গরুর কাঁচা চামড়া মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। ছোট আকারের চামড়া ৬০০ টাকাতেও বিক্রি হতে দেখা গেছে— যা গত বছরের সঙ্গে প্রায় একই রকম। ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়, এ পণ্যটির প্রতি আগের মতো এবারও আগ্রহ দেখাননি আড়তদাররা।

সরকারি দাম বৃদ্ধির ঘোষণা থাকলেও বাজারে স্থবিরতা কাটেনি।

বাজার নির্ধারিত দাম বনাম বাস্তবতা

গত ২৬ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করে। সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০-২২ টাকা।

কিন্তু মাঠপর্যায়ের ছবি বলছে, এসব দরের কোনও বাস্তব প্রতিফলন নেই।

সরবরাহ ও লক্ষ্য

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিলো প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু। ট্যানারি মালিকেরা এবার ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।

পোস্তা ও মাঠের অভিজ্ঞতা

পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলোতে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয় বড় পরিসরে। বিকেলে আড়তে গিয়ে দেখা যায়, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসার কর্মকর্তারা রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে করে চামড়া নিয়ে আসছেন। আড়তদার ও পাইকাররা দরদাম করে চামড়া কিনছেন।

আড়তদার শহীদুল ইসলাম জানান, বাজার ভালো নয়। ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় গরুর চামড়া কিনছি। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী বেশি দামে কিনে এনে ক্ষতিতে পড়ছেন।

সুমন অ্যান্ড সন্সের মালিক মো. শরীফ বলেন, প্রতিটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনছি। প্রক্রিয়াজাতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ৩৫০-৪০০ টাকা খরচ পড়বে, বাজার মন্দা হওয়ায় কিছুটা কম দামেই কিনতে হচ্ছে।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ক্ষতির অভিযোগ

কলাবাগান থেকে ১৩টি গরুর কাঁচা চামড়া সায়েন্সল্যাব এলাকায় এনে বিক্রির চেষ্টা করেন মৌসুমি ব্যবসায়ী কাউছার আহমেদ। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে তিনি এসব চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কিনে আনেন এবং বিক্রির জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দর হাঁকেন। কিন্তু কোনো আড়তদার বা ট্যানারি ৭৫০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি। শেষে ৭৫০ টাকাতেই সবগুলো চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন।

তিনি বলেন, যে আকারের চামড়া এনেছি, সেগুলোর দাম হওয়া উচিত ছিল অন্তত ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। কিন্তু লোকসান করেই বিক্রি করতে হলো। ভ্যান ভাড়া ও সহকারী মজুরি দিয়ে হাতে কিছুই থাকছে না।

ট্যানারির সংগ্রহ পরিকল্পনা

সায়েন্সল্যাব এলাকায় কালাম ব্রাদার্স ট্যানারির পরিচালক সাজেদুল খায়ের জানান,৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে গরুর চামড়া কিনেছি। গত বছরের তুলনায় ৩০-৫০ টাকা বেশি দাম পাচ্ছি। এ বছর এক থেকে দেড় লাখ লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য আমাদের।

বড় আকারের গরুর চামড়া কিছুটা ভালো দামে বিক্রি হয়েছে। মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান,৩২ লাখ টাকায় কেনা দুটি গরুর চামড়া ৩ হাজার টাকায় কিনেছি—প্রতিটি দেড় হাজার টাকায়।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এ বছর ছোট গরুর চামড়া বেশি। সরবরাহ ভালো। গত বছরের তুলনায় প্রতিটি চামড়ায় ১০০-১৫০ টাকা বেশি দাম রয়েছে। আমরা পাঁচ থেকে ছয় লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছি। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কাঁচা চামড়া কিনছে।

সার্বিক চিত্র

ফলে আবারও দেখা গেল—সরকার নির্ধারিত চামড়ার দরের সঙ্গে মাঠের বাস্তবতার কোনও মিল নেই। দাম বৃদ্ধির ঘোষণা সত্ত্বেও অধিকাংশ গরুর চামড়া ৭০০-৯০০ টাকাতেই বিক্রি হয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পড়েছেন লোকসানে।

ছাগলের চামড়ার প্রতি বাজারের আগ্রহ ছিল আরও কম। ফলে পুরো বাজারে নির্ধারিত দরের বাস্তবায়ন প্রায় অকার্যকর থেকে গেছে।

সবার দেশ/কেএম