Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ০২:১৪, ২৩ মে ২০২৫

আপডেট: ০২:১৭, ২৩ মে ২০২৫

এক জয়ের হারের গল্প: ‘জনতার মেয়র’ থেকে ‘ক্ষমতার মেয়র’

এক জয়ের হারের গল্প: ‘জনতার মেয়র’ থেকে ‘ক্ষমতার মেয়র’
ছবি: সবার দেশ

রাজনীতিতে কখনও কখনও এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেটা ইতিহাসের পাতায় ‘বিজয়’ হিসেবেই লেখা হয়, কিন্তু সে বিজয়ের ভেতরেই থাকে এক গভীর পরাজয়ের বীজ। ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের সাম্প্রতিক মেয়র পদে বিজয় আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হলেও, তার পরবর্তী কিছু রাজনৈতিক আচরণ সে বিজয়ের মর্যাদা ও সৌন্দর্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

এ গল্প এক জয়ের, কিন্তু সে জয়ের হলো আদর্শিক পরাজয়। এ গল্প সাদেক হোসেন খোকার মতো একজন শ্রদ্ধাভাজন মুক্তিযোদ্ধা, আপাদমস্তক রাজনীতিকের আদর্শ ও স্মৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে; যার উত্তরসূরি হিসেবে ইশরাক হোসেন দেশের বিরুদ্ধস্রোতের সাহসী মুখ হয়ে উঠেছিলেন—কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আবেগ ও কৌশলের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন বলেই ধারণা অনেকের।

সাদেক হোসেন খোকা—একটি নাম, একটি ইতিহাস, এক অহংকার। বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচিত মেয়র এবং এক সময়ে শেখ হাসিনাকে বিপুল ভোটে পরাজিত করা দুর্দমনীয় নেতা। রাজনীতির মাঠে তার উপস্থিতি যেমন ছিলো দৃঢ়, তেমনি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন বিনয়ী, জনগণের আস্থাভাজন। 

যে মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বুক পেতে দিয়েছিলেন, তাকে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে দেশের মাটিতে ফিরতে না দেয়ার নিষ্ঠুরতা রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বিকারভাবে দেখেছে। আর তাই, তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যতোটা না রাজনীতি হয়েছে, তারচেয়েও অনেক বেশি হয়েছে আঘাত, বেদনা আর এক নিঃশব্দ অভিমান।

খোকার উত্তরসূরি: প্রত্যাশার পাহাড়

খোকার পুত্র ইশরাক হোসেন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন বাবার আদর্শ ও শহীদ মিনার ঘেরা সম্মানের আবহে। তার ভাষণ, তার সাহস, আন্দোলনের মাঠে দৃপ্ত উপস্থিতি তরুণ প্রজন্মকে মুগ্ধ করেছিলো। ধানের শীষ নিয়ে ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়া, পরে সহিংস পরিস্থিতিতে লড়ে যাওয়া, ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ এবং দৃঢ় অবস্থান তাকে তরুণদের কাছে এক ধরনের প্রতীক বানিয়েছে। পুলিশের হাত থেকে দলীয় কর্মীকে বাঁচানোর দৃশ্যটি যেনো ২১ শতকের রাজনৈতিক পোস্টারে এক সাহসী চিত্র হয়ে উঠেছিলো।

ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে নিয়ে অনেকেই আশাবাদী ছিলেন। তার শৈশব, পারিবারিক চেতনা ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা জীবন তাকে যোদ্ধা করে গড়ে তুলেছিলো।  একদিকে সাহস, অন্যদিকে দলের প্রতি দায়বদ্ধতা—সব মিলিয়ে মনে হয়েছিলো, ইশরাক শুধু খোকার উত্তরসূরী নন, তিনিই হতে পারেন বিএনপির ভবিষ্যতের নেতৃত্বের অন্যতম মুখ। তখন অনেকেই বলেছিলেন—প্রতিটি বিভাগে যদি একজন করে ইশরাক থাকতেন, তাহলে ‘খুনি হাসিনা’ পালিয়ে যেতে বাধ্য হতেন। সে আবেগই ইশরাককে ‘জনতার মেয়র’ অভিধায় ভূষিত করেছিলো।

আরও পড়ুন <<>> সংখ্যালঘু ইস্যুতে অপপ্রচার মোকাবেলায় তথ্যভিত্তিক কৌশল জরুরি

এ বাস্তবতায় যখন তার নির্বাচনী বিজয়ের আইনি স্বীকৃতি এলো, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন—এ এক নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার দিগন্ত। দীর্ঘদিন পর যেন এক ‘আইনি বিজয়’ রাজনীতির বিরুদ্ধধারা ভেঙে এনে দিয়েছে নিপীড়িত পক্ষকে কিছুটা অক্সিজেন। এ রায় শুধু ইশরাকের ব্যক্তিগত জয় নয়, এটি ছিলো গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের জন্য এক নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মুহূর্ত। রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত এক তরুণ নেতার পক্ষে আইনের জয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ বিজয় যেন তৎক্ষণাৎ তার রাজনৈতিক উচ্চতা এবং মূল্যবোধকে খর্ব করে ফেলেছে।

আইন নয়, অহংকারই অগ্রাধিকার পেলো?

আমরা দেখেছি, এ জয় ঘোষণার পর ইশরাক হোসেন প্রশাসনকে অগ্রাহ্য করে, বিচারাধীন বিষয়কে উপেক্ষা করে সরাসরি নগরভবনে ‘দখল অভিযান’ শুরু করেন। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম, নগরবাসীর স্বাভাবিক সেবা, অফিস কার্যক্রম—সবকিছুই যেন থমকে দাঁড়ায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ‘আমি বিজয়ী, সুতরাং নগরপিতা আমিই’—এ মনোভাব তার তৎপরতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে এক আদর্শিক ‘জনতার মেয়র’-এর ছবি ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকে।

যেখানে এ জয় হতে পারতো একটি আদর্শ রাজনীতির দৃষ্টান্ত, সেখানে তা পরিণত হলো এক ‘দখল ভিত্তিক’ তৎপরতায়। যেখানে প্রত্যাশা ছিলো—তিনি হয়তো অবৈধ সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ের শপথ নেবেন না, বরং জনগণের ম্যান্ডেটের পক্ষে একটি নৈতিক অবস্থান নেবেন; সেখানে দেখা গেলো তিনি কেবল চেয়ারে বসার আকাঙ্ক্ষায় দিকভ্রান্ত এক ‘ক্ষমতার রাজনীতি’তে অবতীর্ণ হয়েছেন। মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে ম্যান্ডেট কেবল ভোট নয়, তা আইন, প্রক্রিয়া ও মূল্যবোধের সম্মিলন।

রাজনৈতিক আদর্শের পরাজয়

আমরা জানি, তিনি আদালতের রায়ে জয়ী হয়েছেন, তবে সে জয় রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও প্রক্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে হার মেনেছে। আদালতের আদেশ মানেই সাথে সাথে ক্ষমতা গ্রহণ নয়। ইসির গেজেট, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন—সবই একটি আইনি প্রক্রিয়ার অংশ। বিএনপি নিজেই দীর্ঘকাল ধরে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে—সরকারি হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব, প্রশাসনিক দুর্ব্যবহার এসবের বিরুদ্ধে। অথচ, আজ বিএনপিরই তরুণ মুখ সে একই ব্যবস্থার ভেতরে থেকে ‘দখলবাদী’ আচরণ করে বসছেন—এ যেন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উঠে আসে। তিনি বারবার অবৈধ কোনও শাসনব্যবস্থার সঙ্গে আপস করেননি, এমনকি ব্যক্তিগত মুক্তির বিনিময়ে নয়, বরং জনগণের ভোটাধিকারের প্রশ্নে দীর্ঘ কারাবাসকেও বরণ করে নিয়েছেন। সে চেতনার বিপরীতে আজ ইশরাকের আচরণ যেন এক ক্লান্ত আত্মসমর্পণ।

কে হারলো, কে জিতলো?

আমরা একদিকে দেখলাম আদালতের রায় অনুযায়ী নির্বাচনী ফলাফলে তার জয় স্বীকৃত হলো। অন্যদিকে, এ জয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য তিনি নিজেই ভূলুণ্ঠিত করলেন। রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা, আইনের শাসন ও নৈতিক নেতৃত্ব—এ তিনের অনুপস্থিতি তার এ জয়কে পরিণত করেছে এক দৃষ্টান্তমূলক ব্যর্থতায়।

আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ সময়েও তিনি নাগরিক সেবাকে পণ করে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে চেয়েছেন। একজন মেয়রের দায়িত্ব নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করা। নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও, তার উচিত ছিলো প্রতিকূলতাকে ধৈর্য ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করা। কিন্তু তিনি তা না করে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে পঙ্গু করে দিয়েছেন। এতে নগরবাসী যেমন কষ্ট পেয়েছে, তেমনি তার ওপর আস্থা রাখার মত অনেক তরুণও বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

যে ইশরাককে জনতা ভালোবেসে ‘জনতার মেয়র’ বানিয়েছিলো, সে ইশরাকই কীভাবে আদালতের আদেশকে ব্যবহার করে নগরবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালেন? কেনই বা তিনি রিট শুনানির রায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না? সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিএনপি যেভাবে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ঠেকিয়েছিলো, আজ কেনো সে সংবিধান উপেক্ষিত?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মেয়র হিসেবে তার মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেছে ১৫ মে। তার মানে, এমনিতেই এ মেয়াদে কাজ করার সুযোগ আইনি দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ। তখন এই চেয়ার আঁকড়ে ধরা কি জনগণের প্রতি দায়িত্ব, নাকি পদ-ভোগের আকাঙ্ক্ষা?

এখানে এসে প্রশ্ন ওঠে, কী হারালো এ ‘জয়’-এ? একজন তরুণ, জনপ্রিয়, আন্দোলননির্ভর নেতার যে উদার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিলো, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। তিনি যেন পিতার মত রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ধারণ না করেই আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন।

রাজনীতি শুধু হুঙ্কার নয়, রাজনীতি হলো ধৈর্য্য, কৌশল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের খেলাও। একটি জয় তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তার ফলাফলকে আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তোলা যায়। সেখানে ইশরাক, দুঃখজনকভাবে, হেরে গেছেন।

পরিণতি ও ভবিষ্যৎ শিক্ষা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে রয়েছে, যেখানে রাজনীতি ও নেতৃত্বের নতুন ধারার প্রয়োজন। যেখানে নেতৃত্ব মানে হবে—সহিষ্ণুতা, মূল্যবোধ, আইন-আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা। ইশরাক হোসেন যদি সত্যিই দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে জায়গা পেতে চান, তবে আজকের এ ঘটনার পুনর্মূল্যায়ন তাকে করতেই হবে।

এ পর্বের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, রাজনৈতিক ইতিহাসে জয় কখনো কেবল আদালতের রায়ে নির্ধারিত হয় না—তাকে পূর্ণতা দেয় নৈতিক অবস্থান, আদর্শে দৃঢ়তা এবং জনসেবার প্রতি দায়বদ্ধতা। বিরোধী রাজনীতির মুখ হিসেবে শুধু রাজপথে সাহসিকতা নয়, নেতৃত্বে দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও নৈতিক দৃঢ়তাও জরুরি। নইলে জনগণ যাদের কাঁধে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, তারা হয়তো আর কখনও ফিরে তাকাবেন না।

ইশরাক হোসেন এখনো তরুণ। তার হাতে রয়েছে বহু সময়, বহু সম্ভাবনা। কিন্তু এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক শিক্ষা নিলেন—তা যদি তিনি আত্মস্থ করতে পারেন, তবে এখনও তার সামনে রয়েছে নিজেকে পুনরুদ্ধারের পথ।

জয় হোক আদর্শের, আইন ও প্রক্রিয়ার—না যে কোনও মূল্যে ‘চেয়ারে’ বসার! আজকের বাংলাদেশে সেটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

২৩ মে ২০২৫
সম্পাদক

শীর্ষ সংবাদ:

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করছেন: বিবিসিকে নাহিদ
পাকিস্তানে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে চীন
পাকিস্তানের সঙ্গে একই গ্রুপে বিশ্বকাপ খেলবে না ভারত
যে কুমির ডেকে আনছেন, তা আপনাদেরই খাবে: আসিফ মাহমুদ
বিএনপি সরকার হটিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়: এনসিপির অভিযোগ
জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে চাই আত্মত্যাগের মানসিকতা: আজহারি
সর্বদলীয় বৈঠক ডাকুন: প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত আমির
সেনানিবাসে আশ্রয় দেয়া ৬২৬ জনের তালিকা প্রকাশ
আরেকটা এক-এগারো চাই না, আর চুপ থাকবো না: এনসিপি নেতা রিফাত রশিদের হুঁশিয়ারি
দেশের স্বার্থে বিভাজন মিটিয়ে ফেলতে হবে: হাসনাত আব্দুল্লাহ
মেঘনায় বিএনপির ঘরে আওয়ামী দোসরদের আশ্রয়!
দুঃখ প্রকাশ করলেন মাহফুজ আলম
৮ দিনের ভোগান্তির আন্দোলন স্থগিত করলেন ইশরাক