বিরল সম্মানের নজির:
রাজনীতির ফিনিক্স পাখি খালেদা জিয়া
বেগম জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে ভাষাকে অস্ত্র বানিয়েছেন ঠিকই, তবে তা ছিলো শালীনতার, নীতির এবং অমূল্য আত্মমর্যাদার প্রতীক।

ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন কিংবা বাংলাদেশের পতিত হাসিনা—এদের সবাই নিজ নিজ দেশে ক্ষমতার চূড়ায় উঠেছেন, কেউ নির্বাচনে, কেউ শক্তির জোরে। কিন্তু ক্ষমতা প্রাপ্তির গৌরব আর সম্মানের ভিত্তিতে স্মরণীয় হয়ে ওঠা—এ দুইয়ের মাঝে ব্যবধান অনেক গভীর। এ ব্যবধানই একজন রাজনীতিককে পরিণত করে একজন রাষ্ট্রনায়ক, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে পরিণত করে জাতীয় চেতনার প্রতীক-এ।
এ দিক থেকে বিচার করলে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মান ও রাজনৈতিক মহিমা আজকের বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়। তিনি এখন আর কেবল একজন রাজনীতিক নন, বরং একটি আদর্শ, একটি রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও একটি জাতিসত্তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
৫ আগস্টের সেনাকুঞ্জ—এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত
৫ আগস্ট সেনাকুঞ্জে যা ঘটেছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য ও স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ দিনে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা, সেনা পরিবারের প্রতিনিধিরা, জুলাই বিপ্লবের ছাত্রনেতারা এবং প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা। উপস্থিত ছিলো সাধারণ মানুষও—বিনা আমন্ত্রণে, হৃদয় থেকে, এক দৃষ্টান্তমূলক সম্মান জানানোর জন্য। এ সম্মান কেবল রাজনীতির কারণে নয়, এ সম্মান একজন নারী নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস, আত্মত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং নীতির প্রতি শ্রদ্ধা থেকে উৎসারিত।
কাতারের আমিরের শুভেচ্ছা—বৈশ্বিক কূটনৈতিক বার্তা
বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রার আগে কাতারের আমির যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দুইদিন আগেই ঢাকায় পাঠিয়ে রেখেছিলেন, এবং ফেরার সময়ও একইভাবে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন—এটি বিশ্বরাজনীতির ভাষায় একটি স্পষ্ট বার্তা। এ হলো এক ধরনের ‘রাজনৈতিক কূটনৈতিক শ্রদ্ধা’, যা কেবল রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য নয়—জাতির কাছে, বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠা ব্যক্তিত্বদের জন্যই সংরক্ষিত থাকে।
আরও পড়ুন <<>> শ্রমিকের ঘামে গড়া দেশ অধিকারেই হোক রক্ষা
একটি দমনমূলক রাজনৈতিক বাস্তবতায় বছরের পর বছর কারাবন্দী থাকা, শারীরিক কষ্ট সহ্য করা, তবু নিজের দলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো নয়, রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নতজানু না করা—এ সবই বেগম জিয়াকে ‘একটি লড়াই করে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও বিনয়ী থাকা রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
বাক্যচয়নেই রাজনীতির প্রতিফলন
রাজনীতির ভাষাও একজন নেতার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। যখন কেউ ক্ষমতায় থেকে বলে—‘২২৭টা খুন করার লাইসেন্স পাইলাম’, তখন তা ক্ষমতার উন্মত্ত প্রকাশ হয়ে ওঠে। আর যখন আরেকজন বলেন—‘রাগ করে কী করবো? আল্লাহর নিকট বিচার দেই’, তখন তা একজন রাষ্ট্রনায়িকের নরম অথচ অমোঘ শক্তির প্রতিফলন হয়ে ওঠে। তখন সেখানে ধৈর্য, আস্থাশীলতা এবং মানবিক সংবেদনশীলতার প্রতিফলন ঘটে। এ ভাষাগত পার্থক্য কেবল rhetorical contrast নয়; বরং এটি নেতৃত্বের দুই ভিন্ন দর্শনকে চিহ্নিত করে—একদিকে প্রতিহিংসাপরায়ণ, অন্যদিকে আত্মস্থ ও জনমুখী।
বেগম জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে ভাষাকে অস্ত্র বানিয়েছেন ঠিকই, তবে তা ছিলো শালীনতার, নীতির এবং অমূল্য আত্মমর্যাদার প্রতীক।
একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা
বেগম জিয়ার দীর্ঘ কারাবরণ, রাজনৈতিকভাবে অবরুদ্ধ থাকা, আইনি জটিলতার মধ্যেও তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্ব্যবহার বা প্রতিহিংসার বার্তা জনগণের সামনে আসেনি। বরং প্রতিটি সংকটে তিনি নীরবতা, সংযম এবং রাষ্ট্রীয় শালীনতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এটি তার ব্যক্তিত্বের অন্যতম শক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যও একটি ইতিবাচক দিকচিহ্ন।
দায়িত্ববোধ ও ত্যাগ—জনগণের মমত্ববোধের মূল উৎস
যুগে যুগে রাজনীতিতে আসেন অনেকেই। কেউ জনপ্রিয় হন কর্মসূচি দিয়ে, কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকেন বলপ্রয়োগে। কিন্তু যে নেতা জনগণের অন্তরের প্রেরণায় জায়গা করে নেন, তাকে সরিয়ে রাখা যায় ক্ষমতা থেকে, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা থেকে নয়। বেগম খালেদা জিয়া সে বিরল ব্যতিক্রম, যিনি দল, মত ও বয়সের সীমা পেরিয়ে আজ একটি জাতীয় আবেগের রূপক হয়ে উঠেছেন।
তিনি চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশ যেতে বাধা পান ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়, আবার ফিরে আসার পথেও বাধার দেয়াল তৈরির প্রপাগান্ডা চালানো হয়। কিন্তু এও সত্য—বিশ্ব নেতৃত্ব, প্রবাসী কূটনীতি এবং জনগণের হৃদয় তাকে সবসময় দিয়েছে অন্য এক সম্মানের আসন।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তিত্ব এবং তাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে যে সম্মান প্রকাশিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। বর্তমান রাজনীতির অস্থির, বিভাজনমুখী পরিবেশে তার মত সংযমী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব কেবল স্মরণীয়ই নয়, অনুসরণীয়।
বেগম জিয়াকে ঘিরে গড়ে ওঠা সম্মান শুধু একজন রাজনীতিকের জন্য নয়, বরং গণতন্ত্র, সহনশীলতা ও সভ্য রাজনীতির পক্ষের মানুষের এক যুগান্তকারী বার্তা।
আজকের বিশ্বে সত্যিই প্রশ্ন আসে—ডোনাল্ড ট্রাম্প, পুতিন, কিম জং উন কিংবা হাসিনা—ক্ষমতা তো এরা পেয়েছেন, কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার মতো স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধার অভূতপূর্ব সম্মান কি তারা কেউ পেয়েছেন?
উত্তর—না।
এবং এ উত্তর কেবল আবেগপ্রবণ নয়, ইতিহাসপ্রবণ। এই ইতিহাস চলমান থাকবে, ভবিষ্যতের প্রজন্ম যাকে অধ্যয়ন করবে একজন জাতীয় অনুপ্রেরণা হিসেবে।
৯ মে ২০২৫
সম্পাদক