সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট?
সেনাপ্রধানকে সরানোর গুঞ্জনে সামরিক অস্থিরতা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ঘিরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোতে অস্বস্তিকর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ পরিস্থিতি ৯০-এর পর সেনাবাহিনীর সাথে সরকারের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় টানাপোড়েনের ইঙ্গিত বহন করে।
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সেনাপ্রধান জেনারেল এস.এম. ওয়াকারের ‘টার্মিনেশন’-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বা গুঞ্জন সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে আলোচিত হয়। এর সূত্রপাত নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা—পিএসও ওয়ান জেনারেল কামরুল আহমেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঘিরে সামরিক বাহিনীর কিছু অংশে অসন্তোষ থেকে।
গভীর অসন্তোষ: তথ্য, গুজব, নড়াচড়া
সূত্র অনুযায়ী, সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টার থেকে জেনারেল কামরুলের বদলি চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে দু’দফা আবেদন করা হলেও, উভয়বারই দফতর থেকে ‘অপেক্ষা করতে বলা হয়’। এরপরই ছড়ায় যে জেনারেল ওয়াকারের ‘টার্মিনেশন’-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে, ওইদিন রাতেই সেনাবাহিনীর একাধিক ইউনিটকে ‘প্রস্তুত থাকতে’ মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়। রাজধানীর কূটনৈতিক জোনে বাড়তি তৎপরতা দেখা যায়, সাময়িকভাবে ইন্টারনেট সংযোগও ৪০ মিনিটের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলো।
এমন প্রেক্ষাপটে জেনারেল ওয়াকার নাকি তার ঘনিষ্ঠ স্টাফদের কাছে বিদায়বার্তা দেন—যা সেনা সদর দফতরে ভিন্নধর্মী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বিশেষত, বিভিন্ন মিডিয়া ও পর্যবেক্ষক তখন বিষয়টিকে গুজব হিসেবে উল্লেখ করলেও, সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নড়াচড়ায় তা গুজবের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাস্তব উদ্বেগ হিসেবে ধরা পড়ে।
সেনা দরবারে স্পষ্ট বার্তা
এ ঘটনার ধারাবাহিকতায়, চলতি সপ্তাহে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ দরবারে জেনারেল ওয়াকার নির্বাচন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং কক্সবাজার করিডর নিয়ে যেভাবে কথা বলেন—তা অনেকের চোখে ‘গভীর বার্তা’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ওই বক্তব্য ৯০ পরবর্তী কোনো সেনাপ্রধানের সবচেয়ে রাজনৈতিক ভাষ্য।
‘পিনাকী-খলিল গ্রুপ’ ও আস্থার সংকট
নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলের প্রতি সেনাবাহিনীর একটি অংশের আস্থা সংকট দীর্ঘদিনের। তাকে ঘিরে কথিত একটি ‘গ্র্যান্ড ডিজাইনের’ কথা উঠে আসে—যার পেছনে কিছু বিতর্কিত বুদ্ধিজীবীর প্রভাব রয়েছে বলে অভিযোগ।
ড. খলিলের সঙ্গে ড. ইউনূস, জেনারেল কামরুল এবং কথিত ‘পিনাকী গ্রুপ’ এর ঘনিষ্ঠতা নিয়েও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
একটি ভিডিওতে পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, ‘পিনাকি যদি অর্জুন হয়, খলিল হলো কৃষ্ণ।’
সেনাবাহিনীর একটি অংশ মনে করছে, এ ধরনের বক্তব্য সরকারের নিরাপত্তা কাঠামোয় বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়।
ড. ইউনূসের পদত্যাগ ভাবনা?
উদ্বেগ বাড়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ মহলে তার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ—যদিও সেটি দাফতরিকভাবে গৃহীত হয়নি। তবে বিশ্বব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এ সংকট অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
সামরিক ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন
সামরিক ইতিহাসে দেখা গেছে, সেনাপ্রধানকে সরানোর প্রচেষ্টার ফলাফল অনেক সময় রাষ্ট্রনায়কদের পতনে গিয়ে ঠেকে। পাকিস্তানে জেনারেল জিয়া-উল-হক, মুশাররফ এবং মিশরে জেনারেল সিসির ঘটনাগুলো তার উদাহরণ। তবে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী বিগত তিন দশক ধরে নির্বাচিত সরকারের প্রতি অনুগত থেকেছে—এমনকি রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল সময়েও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি।
এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান অস্থিরতা নতুন ধরনের উদ্বেগ তৈরি করছে। কারণ সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়—এটি জনগণের আস্থার প্রতীক। এ আস্থায় চিড় ধরলে তার অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিফলিত হবে।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সামরিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ, দুর্বল গণতান্ত্রিক কাঠামোর রাষ্ট্রের জন্য অশনি সঙ্কেত। যত দ্রুত সরকার ও সেনাবাহিনী মিথস্ক্রিয়া ও বোঝাপড়ার পথে না ফেরে, তত দ্রুতই তৈরি হতে পারে একটি 'ইন্সটিটিউশনাল ডেডলক'—যার ভুক্তভোগী হবে সাধারণ নাগরিক।
সবার দেশ/কেএম