গল্প
প্রহেলিকা
একটা ইচ্ছে পোকা মাথার ভিতরে ক্রমাগত গুনগুন করে চলে। সেই পোকাটির নিরবিচ্ছিন্ন ডাক বীণার ঝঙ্কার তোলে তপুর কানে। তার ভিতরে চেনা এক অস্তিত্ব টের পায়, যে তার নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। তার চোখে একটা প্রজাপতির নাচন দৃশ্য ফুটে ওঠে। উড়ে বেড়াচ্ছে– এ ফুল থেকে ও ফুলে। ফুলগুলোও যেন সেই প্রজাপতির প্রতীক্ষায় ছিল। তপুর সামনের ফুলেটার উপর যে প্রজাপতিটি বসেছে, তার চোখে চোখ রাখল সে। গভীর-নীল সে চোখে হাজারো প্রশ্ন, যার একটিরও উত্তর জানে না সে।
সে বোহেমিয়ান। তবুও, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত ষষ্ট ইন্দ্রিয় অনুধাবন করে এক অদৃশ্য শক্তি। অচেনা মানুষ; অচেনা শহরে ভেসে বেড়ানো শৈবালসম। পথ খুঁজে দেবে কি কোনো নতুন পথের সন্ধান? হাওয়ায় হাওয়ায় খুঁজে ফেরে উত্তর।
অচেনা শ্রাবণের বর্ষণসিক্ত বারির অনুর্বর মাটিতেও শেকড় স্থাপনের নিয়ত যে চেষ্টা, সে কি কোনো সার্থক প্রয়াস? যান্ত্রিক সভ্যতার সমাজে বেমানান পথিকের মতো পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুতে চায় কাঙ্ক্ষিত ফেরিঘাটে। তপু আবারও তার ভিতরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়- সে কি কাঙ্ক্ষিত ঘাটে পৌঁছে গেছে! এখানে কি সে নোঙর ফেলবে?
তপু নিজে নিজেই হাসে। মনে মনে বলে তার প্রজাপতি কি তাকে গ্রহণ করবে? নজরের সাথে নজর মিলে আকাঙ্ক্ষার এক আশ্চর্য মায়াজাল সৃষ্টি করে, যাকে উপেক্ষা করার সাধ্য নেই তপুর। ঠিক তখনই একটা মায়াজাল ঘিরে ধরে তাকে। এ এক অদ্ভুত খেলা। তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি পইপই করে কী যেন খুঁজে ফেরে। নাকি কোনো চোখ? মায়াবি দু’টি চোখ।
অধরা, এক গভীর মায়াবি মুখচ্ছবি। কখন, কোন পথে তপুর মতো নিভৃতচারীর মনে ঠাঁই করে নিলো, সে জানতেই পারলো না। নিবিড়, নিঃশঙ্কোচ, সাগরের মতো গভীর দু’টি চোখে মায়াময় হাতছানি। কী করে যেন দু’টি হাত এক হয়ে এক দুর্দমনীয় তোলপাড়ের সৃষ্টি হলো, দু’জনের কেউই বুঝতে পারলো না। তুমুল বৃষ্টির মতো এসে তাদের ভিতর-বাহির ভিজিয়ে একাকার করে দিলো। সেই বর্ষণে সিক্ত হয়ে অধরার মনেও এক শান্ত-রিমঝিম ঝর্ণাধারার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সুখের আবেশ নিয়েই সুদীর্ঘকাল কাটিয়ে দেয়ার এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিজেকে। সে জানতো তপু এক দুর্লভ প্রহেলিকা। তবুও সেই অদ্ভুত মায়ায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে এক অলঙ্ঘনীয় পাহাড়চূড়াকে ডিঙাতে চেয়েছিল সে। কোনো এক মৌন প্রহরে এক বাধ না-মানা জোয়ারে ভেসেছিল দু’জনে, তারপর সেই জোয়ার-ভাটার খেলায় নিজের জীবনটা কখন যে ওলটপালট হয়ে গেল অধরা বুঝতেই পারেনি।
তারপর বোহেমিয়ান তপুকে বেরিয়ে পড়তে হলো এক ঠিকানাবিহীন অজানা পথের সন্ধানে। আর অধরা, ক্রমশ তার সামনে এগিয়ে আসছে এক কঠিন যুদ্ধ।
তপু এখনও প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে খেয়াল করল প্রজাপতির ডান পাখার নিচের দিকটায় বেশ খানিকটা ছেঁড়া। তবে তাতে তার উড়তে খুব একটা যে সমস্যা হচ্ছে, তা কিন্তু না। দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে এ-ফুল থেকে ও-ফুলে। আসলেই কি কোনো কষ্ট হয় না? তপু আবার নিজের ভিতরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। এ পৃথিবীতে চারিদিকে কত কষ্ট! আচ্ছা, তার ভিতরে কি কিছু নেই? কোনো না পাওয়ার আফসোস?
নিজেই নিজেকে উত্তর করে- থাকলেই কী! কারো বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই, তবে একটা শূন্যতা আছে। গভীর শূন্যতা। অধরা। কখন যে ধরা দেয়, আবার কখন যে দেয় না, তা একেবারেই বুঝতে পারে না তপু। হঠাৎ নিজেকে বড় রিক্ত মনে হতে লাগলো। ভিতরে এক ধরণের ফাঁকা ভাব। আবার মনে ভেসে ওঠে গভীর মায়াবী দু'টি চোখ। এ বিশ্ব সংসারের আনাচে-কানাচে কত কত মানুষ! এতো এতো হাজার মুখের ভিড়ে একটি মুখ স্থির পোর্ট্রেট হয়ে আছে। যেখানেই যায়, যত দূরেই যায়- ছায়ার মতো অনুসরণ করে তাকে।
সামাজিক বলয় আবদ্ধ জীবনে মানুষের সব চাওয়াপাওয়া পূরণ হয় না। বিত্ত-ভৈববের ব্যবধান পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তপু জানে যে চোখের গভীরে সে হারিয়েছে নিজেকে, সে এক ধূ-ধূ মরিচিকা। এক ঘোর অস্থিরতা সারাক্ষণ ঘিরে ধরে তাকে। শান্তির খোঁজে ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। কোথাও থিতু হতে পারে না। মনের শেকড় যে অধরা ভুমিতে প্রোথিত। কী করবে সে?
দিনগুলো চলে যায় প্রকৃতির নিয়মে। শূন্যতার চাদরে মোড়ানো স্থির সময়টায় বুদ হয়ে থাকে অধরা। সমস্ত বিশ্ব সংসারের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার আপ্রাণ এক চেষ্টা। সে কি পারবে? সামনে জলমগ্ন শূন্যতা। দখিনা বাতাস জোর তাড়া দেয়। পুকুরের জলের উপরে উতল হাওয়ার দোলা, দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পশ্চিম থেকে পূবে। অধরা চুপচাপ বসে আছে ঘাটে। ভাবনার জগত বড় বিচিত্র। আজ পুরোপুরি দুই মাস হলো ও লাপাত্তা। এখন কী করবে সে? পনের দিন ধরে সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে এক নবসংবাদ। প্রথম যখন কথাটা তার কানে যায়, তার ভিতরেও এক প্রজাপতির নাচন অনুভব করেছিল। তারপরই একটা শঙ্কা, একটা ভয় জাপটে ধরে তাকে। এখন একটাই প্রশ্ন- ও কোথায়?
সময়ের সাথে সাথে সাড়া দেয় ভ্রূণ। এক অবাধ্য শ্রাবণে অলক্ষ্যে ভেসেছিল যে বেহিসেবী জীবন- সে আজ নির্মম সময়ের সাক্ষী। কী করবে সে? এ সমাজ বড় নির্মম, কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ। জানে সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন চারিদিক থেকে ধেয়ে আসবে হিংস্র থাবা। মনে ভেসে ওঠে সেই প্রিয়মুখ। কে যেন ভেতর থেকে ডেকে যায়- তপু তপু তপু ...
অবশেষে স্থির হয় তপু। ছায়াঢাকা নিরালা-নিবিড় এক শান্ত নিবাস। অসংখ্য কচি কচি মুখ, নির্মোহ নিষ্পাপ হাসি। বড় ভালো লেগে গেল তপুর। সিদ্ধান্ত নিলো- এখানেই থিতু হবে সে। এখানে কারো রক্তচক্ষু নেই, দণ্ডকারণ্য থেকে বেরিয়ে এ-ই তার জন্য নিরাপদ স্থান। শৃঙ্খলিত কারাগারের বাইরে পরম সুখের এক বসতি। শুধু আফসোস একটাই- সেই চোখ, সেই মুখচ্ছবি আর দেখা হলো না। যেটুকু সুখস্মৃতি ছিল, তা-ই নিয়েই কেটে যাক আগামির দিনগুলো।
এক শাণিত তরবারির নিচে যেন দাঁড়িয়ে আছে অধরা। মনে শুধু ভয় সেটা কখন নেমে আসবে তার ঘাড়ে। তারপর সব শেষ। সে-ও একরকম ভালো। সব গ্লানি, সব বঞ্চনা থেকে মুক্তি মিলবে। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে আর চোখে ভেসে উঠছে কেবল একটাই মুখ- তপু।
একসময় মুক্তি মিলে যায়। হ্যা, মুক্তিই তো। সবকিছু, সব সম্পর্কের দায় চুকিয়ে একেবারে বিদায় হয়ে যাওয়া কি মুক্তি নয়? এখন আর কোনো ভয় নেই, চোখ রাঙানি নেই, নেই কোনো আড়াল। তবে ভাবনা একটাই- এখন সে আশ্রয়হীনা। একটা আশ্রয় দরকার। তার সঞ্চিত যৎসামান্য নিয়ে পথে নামে সে। তার কর্মস্থল স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। ভরসা একজন- স্কুলে তার সহকর্মী রেহনুমা।
দিনগুলো কেটে যায় দ্রুত। তিন তিনটি বছর কেটে গেল অবলীলায়। তপু এখন খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। তিনকূলে আপন কেউ নেই তার। নিঃসঙ্গ, নির্ঝঞ্ঝাট একাকী জীবন তার। তাই শত মুখ এখন তার সঙ্গী। এদের মাঝেই শান্তি খুঁজে পায় সে। শুধু মনের মাঝে স্থির হয়ে থাকে একটি মুখচ্ছবি- অধরা। কোথায় আছে অধরা? হয়তো এতদিনে অন্য কারো সাথে ঘর বেঁধেছে সে। কীই-বা করার ছিল তার!
মানুষের জীবনের গণ্ডি খুব ছোট, এটা আরও একবার প্রমাণিত হলো। মানুষ চাইলে একদিন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে অনুভব করলো অধরা। তার চোখের সামনে আজ দাঁড়িয়ে আছে সেই মানুষটি, যাকে সে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছে গত তিনটি বছর। পুঞ্জীভূত অভিমানে একবার ভাবে দূরে সরে যাবে সে, আবার মনে পড়ে আজ সে তো আর একা নয়! যে ফুলকে বিগত সময়ে আঁকড়ে ধরে অকূল পাথার পাড়ি দিলো, তাকে কেন বঞ্চিত করবে? একটা শক্ত, নির্ভরতার হাত, একটা শীতল ছায়া তারও তো প্রাপ্য!
আবার ভাবে, মানুষটি তো জানেই না এর অস্তিত্ব! ভেতর থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করে- কেন সে এতদিন কোনো খবর নিলো না? জানবে কী করে! সে তো সেদিন রাক্ষসপুরী থেকে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে! আর, অধরা নিজেই তো তাকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল। আজ কী করে তাকে আবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে? তাছাড়া এতদিন যে ফুলকে আগলে রেখেছে, সে তো শুধু তার একার নয়! ওদেরকে কাউকে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার আছে তার?
আরও পড়ুন <<>> জলমগ্ন অন্ধকারে
তখনই দৃষ্টি পড়ে দু’টি বিস্ফোরিত চোখ পরম বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তপুর চোখেমুখে এক আনন্দের ঝিলিক। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় অধরার। সেই চোখ, সেই মুখ তবে চেহারার সেই ঔজ্জ্বল্য কোথায়? এ কি সেই অধরা! তপু কিছু বলতে যাবে তখনই মুখ খোলে অধরা।
‘কেমন আছ?’
‘এই তো! ঠিকানা পেলে কোথায়?’
‘পাইনি তো! মন থেকে চেয়েছিলাম, বিধাতা মিলিয়ে দিলেন।’
এক প্রশান্তির বাতাস তপুর উতলা অস্থির মনে সুখের দোলা দিয়ে গেল। ঠিক তখনই চোখে পড়ল কচি দু’টি হাত এসে অধরার হাত ধরলো। তপু অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘খুউব সুন্দর।’
‘আমার মেয়ে।’
অধরার চোখে চোখ রাখলো তপু। তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘সে কোথায়?’
‘কে?’
‘যার সাথে ঘর বেঁধেছো।’
‘ঘর তো বাঁধিনি, মন বেঁধেছি যুগ-যুগান্তরের। আর কোনো নতুন ঘরের প্রয়োজন আছে কী?’
তপুর দৃষ্টি সামনের দিকে। যেখানে ফ্রক পরা ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটি ঘাসফুল তুলতে ব্যস্ত। তারপর ঘুরে তাকায় অধরার দিকে। তপুর চোখে প্রশ্ন। অধরা বুঝতে পেরে মৃদু হাসে। মাটির দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে সে বলে,
‘ও তোমারই অঙ্গজ।’
কথাটি বলেই তপুর চোখে তাকায় অধরা। তপুর চোখে বিস্ময় লক্ষ্য করে আবারও মৃদু হেসে উপরে নিচে মাথা নাড়ে অধরা।
তপু প্রসন্ন দৃষ্টিতে সামনে খেলায় মত্ত ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকায়। তারপর অধরার চোখে চোখ রাখে তপু। সে দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন। অধরা শুধু বলে, ‘তুমি চলে আসার পর থেকে আমিও ঘরছাড়া। তিনটা বছর তন্নতন্ন করে তোমায় খুঁজেছি।’
তপু কিছু বলতে যায়, অধরা তাকে থামিয়ে দেয়। অধরার হাতে হাত রাখে তপু। অধরা নিঃশব্দে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। এক নির্ভরতার ছোঁয়া, এক অপার্থিব সুখ।
তপু এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে যায় ঘাসফুলের দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুল-প্রজাপতির মতোই এক নিষ্পাপ আরেক প্রজাপতি। কচি দু’টি হাত দিয়ে আপনমনে তুলে নিচ্ছে ঘাসফুল। তপু সামনে এগিয়ে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয়। সরল শুভ্র মায়াবী এক চাহনি, দ্বিধান্বিত। অধরা স্মিত হাসে, তারপর নিচু গলায় বলে-‘যাও’।
তপু নিজের হাতের মধ্যে অনুভব করে কচি দু’টি হাতের ছোঁয়া। চোখ বন্ধ করে টের পায়- বুকে এক পরম শান্তি, সুখ। চোখ মেলতেই দেখতে পায়- সামনের ফুলের উপর উড়ে এসে বসলো একটি নীল-হলুদ প্রজাপতি, তার দু’টি পাখাই সম্পূর্ণ অক্ষত।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক




























