পররাষ্ট্র সচিবের ‘নীরব বিদায়’

মাত্র আট মাসের মাথায় 'সম্মানজনক অপসারণ'-এর মুখে পড়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছ নিয়োগ ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতীক হয়ে ওঠা এ সচিবকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত—সরকারি সূত্র বলছে, নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে চলতি মে মাসের শুরুতেই।
সে সিদ্ধান্ত বজ্রপাতের মতো নেমে আসে ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরিণতি—পুরো মন্ত্রণালয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
একজন ‘অদৃশ্য উপায়ে আসা’ সচিব
২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। রাতারাতি ওয়েবসাইটে দেখা গেলো নতুন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের নাম। কিন্তু কোথাও তার নিয়োগের অফিস আদেশ নেই। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই। এমনকি ওয়েবসাইটে অন্য সচিবদের নাম পরিবর্তনের আগে যেমন রুটিন প্রজ্ঞাপন জারি হতো, এটিও হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মো. জসীম উদ্দিনের এ নিযুক্তি ছিলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রত্যক্ষ অনুমোদনে। অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাকে পাশ কাটিয়ে একজন বিতর্কিত কূটনীতিককে দায়িত্ব দেয়ার নেপথ্যে একটি ‘নীরব লবির’ সক্রিয় ভূমিকাই মুখ্য ছিল।
জাপান সফরের পূর্বে বিপর্যয়
চলতি মাসের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ঘটনা ছিলো টোকিওতে নির্ধারিত ফরেন অফিস কনসালটেশন (F.O.C.)। বাংলাদেশ-জাপানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির জন্য এ বৈঠক ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ২৮ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাচ্ছেন টোকিও সফরে।
এ বৈঠকের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিলো পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের। কিন্তু নিজের অনাগ্রহ ও মানসিক অবসন্নতায় তিনি সেটি ‘স্থগিত’ করে দেন!
পরিণামে বিপাকে পড়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দ্বিপক্ষীয় সংকেত নষ্ট হয়, জাপান সরকার হতবাক। এমন সিদ্ধান্ত ‘বেইজিং, দিল্লি বা ওয়াশিংটন’—কোনো কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই সাধারণ নয়।
শেষ মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশে সচিব নজরুল ইসলামকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকটি সচিব পর্যায়ের বদলে উপদেষ্টার সফর প্রস্তুতির আলোচনায় পরিণত হয়। এটাই ছিলো মো. জসীম উদ্দিনের গোধূলি-পর্বের সবচেয়ে তিক্ত অধ্যায়।
মন্ত্রণালয়ের পরিবেশে অস্থিরতা
সূত্র বলছে, সচিব এখন কার্যত ‘অফিস করছেন না’—এমন অবস্থায়। সোম ও মঙ্গলবার কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি, মিটিং এড়িয়ে চলেছেন, প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সেরেছেন।
এতে চূড়ান্ত প্রভাব পড়েছে পুরো মন্ত্রণালয়ের কাজের ধারাবাহিকতায়। মিডল লেভেলের কর্মকর্তারা দিশেহারা, ফাইল চলাচল বন্ধ, আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে গতি নেই।
একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় চলছে অটোপাইলটে। সচিব অফিসে এলেও কাজ করছেন না। অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তহীনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির সংকট পুরো সেটআপ অকার্যকর করে ফেলেছে।
বিদায় প্রক্রিয়ার তিন বিকল্প
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এখন বার্লিনে। ১৬ মে দেশে ফিরেই পররাষ্ট্র সচিবের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আলোচনায় রয়েছে তিনটি বিকল্প:
- সচিব স্বেচ্ছা ছুটিতে যাবেন এবং সম্মান বাঁচাবেন।
- তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে অন্য দেশে পাঠানো হবে।
- রাষ্ট্রদূত পদে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টরের দায়িত্বে থাকবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক স্তরে ভারসাম্য বজায় রাখতে এ সিদ্ধান্ত আসলে একটি ‘সম্মানজনক পদত্যাগে বাধ্য করা’র কৌশল।
কে এই মো. জসীম উদ্দিন?
১৩তম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডার থেকে উঠে আসা জসীম উদ্দিন দীর্ঘ কর্মজীবনে কাতার, গ্রিস ও সর্বশেষ চীনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০১৮ সালে গ্রিসে কনস্যুলার পরিষেবায় পুরস্কার পেয়েছিলেন—যেটি ছিলো ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের একমাত্র প্রাপ্তি।
কিন্তু ঢাকায় ফিরে এসে সবকিছু যেন উল্টো পথে হাঁটলো। তাকে যারা আনয়ন করেছিলেন, তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজনৈতিক চাপ, আমলাতান্ত্রিক অসন্তোষ ও আত্মনির্ভরতার ঘাটতি—সবকিছু মিলিয়ে শেষ পরিণতি আজকের এ বিচ্ছিন্নতা।
একটি প্রশ্ন থেকেই যায়...
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন বাংলাদেশের কূটনীতি গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন পররাষ্ট্র সচিবের এমন আকস্মিক ‘মনমরা বিদায়’ আদতে কি দেশের স্বার্থকে নড়বড়ে করছে না? একজন সচিবের ‘মন খারাপ’ কিংবা রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের খেসারত কি দিতে হবে দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে?
সবার দেশ/কেএম