বিডিআর হত্যাকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তদন্ত কমিশনের
হত্যার অনুমোদন দেন তাপস, জিম্মি করান সেলিম
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার ১৬ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার তাপস এবং তাদের জিম্মি করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পাওয়ার তথ্য বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের জানিয়েছিলেন শেখ সেলিম।
এ তদন্ত প্রতিবেদন গত ৩০ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়া হয়। প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে ১৪টি এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগ এনে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে তাপসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা, হত্যার অনুমোদন প্রদান, হত্যা ও লাশ গুম, নারী ও শিশু নির্যাতন, আলামত ধ্বংস, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট, ব্যক্তিগত সম্পদ লুট, অপরাধীদের পলায়নে সহায়তা, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সমন্বয়, হত্যাকারীদের পক্ষে মিছিল সংগঠন, তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, হত্যাযজ্ঞ চলাকালে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ও পালিয়ে যেতে সহায়তা, সামরিক অভিযানে বাধা প্রদান, সত্য গোপন, সেনা কর্মকর্তাদের অপহরণ, সাক্ষীদের নির্যাতন এবং বিদ্রোহের আগাম তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করা।
অন্যদিকে শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে— ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা, হত্যার জন্য সবুজ সংকেত প্রদান, ইন্ধন জোগানো, সত্য গোপন, বিদ্রোহের তথ্য গোপন করা, কমিশনের তদন্তে অসহযোগিতা এবং হত্যাকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পক্ষে অবস্থান নেয়া।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ থেকেই ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। হত্যাকারীদের একটি দল প্রায়ই তার চেম্বারে এসে বৈঠক করতো। বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ব্যাপারে তার অনুমোদন ছিলো বলে সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে। ঘটনার দিন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম যখন বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের নামে আলোচনা করতে যান, তখন বিদ্রোহী সদস্যরা তাপসকে খুঁজছিলো বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাক্ষ্যে আরও বলা হয়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ব্যারিস্টার তাপসকে বিডিআরের মহাপরিচালক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকা সত্ত্বেও তাপস এ বিষয়ে বিডিআরের ডিজিকে কিছুই জানাননি। হত্যাকাণ্ডের পর যমুনায় বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনেও তিনি হত্যাকারীদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিলখানার চারপাশের তিন কিলোমিটার এলাকা খালি করার নির্দেশ দেন তাপস। এতে হত্যাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। সিপাহি মুহিত ও সাজ্জাদের ভাষ্যমতে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন তানভীর হায়দার নূরকে পিলখানা থেকে বের করে নিয়ে যান তাপস। এমনকি র্যাবের টিএফআই সেলে উপস্থিত হয়ে তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি একাধিক বিডিআর সদস্য তার বাসায় সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করার পরামর্শ দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলে তা জানাবেন বলে আশ্বাস দেন। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি সিপাহি মইনুদ্দিনকে ফোন করে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার কথা জানান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডিজিএফআই রেকর্ড করা একটি ফোন কলে তাপস মিছিল সংগঠিত করে বিডিআর সদর দফতরে ঢোকার নির্দেশ দেন। পরে হাজারীবাগ এলাকা থেকে জুয়েল নামে এক যুবককে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে, তাপসের নির্দেশেই সে মিছিল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো এবং ওই মিছিলে যুবলীগের সদস্যরাও ছিলো।
কমিশনের মতে, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের বহু আগেই ব্যারিস্টার তাপস, শেখ সেলিম, সাহারা খাতুন, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমসহ কয়েকজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা এ ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় নেতা তোরাব আলী তাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এককভাবে রাজনৈতিক সমাধানের সিদ্ধান্ত নেন এবং যমুনায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সে সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। এর ফলে সামরিক অভিযান বাধাগ্রস্ত হয় এবং হত্যাকারীরা পালানোর সুযোগ পায়। এমনকি ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তাপস, নানক ও মির্জা আজমের নিয়ন্ত্রণে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে আহত ব্যক্তির ছদ্মবেশে সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের পিলখানা থেকে বের করে নেয়া হয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের আগেই ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম দেশত্যাগ করেন। কমিশনের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দিতে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও তারা কেউই সাক্ষ্য দেননি।
সবার দেশ/কেএম




























