Sobar Desh | সবার দেশ আবু ইউসুফ


প্রকাশিত: ০০:০৯, ১২ নভেম্বর ২০২৫

নিষিদ্ধ বয়ান

৫৪ সেকেন্ডের ছাত্রলীগ, রাজপথ হারানো রাজনীতির প্রতিচ্ছবি

এ মিছিল যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের চোখ খুলে দেয়, যদি তারা বুঝতে পারে ক্ষমতার চেয়ে জনগণের ভালোবাসাই বড় শক্তি, তবেই হয়তো ৫৪ সেকেন্ডের এ ভিডিও ইতিহাসে এক শিক্ষা হিসেবে টিকে থাকবে। অন্যথায়, আগামী দিনে তাদের রাজনীতি শুধু রাজপথ নয়, ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যাবে।

৫৪ সেকেন্ডের ছাত্রলীগ, রাজপথ হারানো রাজনীতির প্রতিচ্ছবি
ছবি: সবার দেশ

খবরে প্রকাশ, সোমবার (১০ নভেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে শৈলকূপা উপজেলার ভাটই বাজারে পার্শ্ববর্তী কোনও একটি গ্রামীণ সড়কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মশাল হাতে মিছিল করেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে সোমবার দিবাগত মধ্যরাতের কোনও একসময় এ মিছিল করে নিমিষেই গায়েব হয়ে যায় তারা। এতে ৮ থেকে ১০ জন অংশ নেয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মিছিলটি মাত্র ৫৪ সেকেন্ড স্থায়ী ছিলো। শৈলকুপা উপজেলার ভাটই বাজারে মৃদুস্বরে কয়েকবার স্লোগান দেয়ার পর তারা ওই এলাকা থেকে চলে যায়। তাদের মুখে মাস্ক পরা ছিলো। 

এ বিষয়ে শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান বলেছেন, একটি মিছিলের ভিডিও দেখেছি। মিছিলটি আসলে কোথায় হয়েছে, তা জানার চেষ্টা করছি। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার করতে আমাদের টিম কাজ করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রলীগ নামটি একসময় ছিলো এক শক্ত প্রতীকের নাম। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিবীজ বপনের ইতিহাস থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, এমনকি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও যুগপৎ আন্দোলনে তারা ছিলো রাজপথের অগ্রভাগে। কিন্তু আজ? মাত্র ৫৪ সেকেন্ডের একটি মিছিল—যা রাজপথে না, সম্ভবত কোনও চিপা গলিতে—এটাই এখন একদা দুর্বার ছাত্রলীগের বাস্তবতা। 

৫৪ সেকেন্ডের সে ভিডিও আজ বাংলাদেশের রাজনীতির এক গভীর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে: ক্ষমতার পতনের পর রাজপথে কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলা এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির নগ্ন চিত্র।

একদা রাজপথ কাঁপানো সংগঠনের পতন

ছাত্রলীগ মানে একসময় রাজপথের দাপট। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহল্লা, ব্যারিকেড থেকে ব্যালট—প্রতিটি সংগ্রামে তাদের উপস্থিতি ছিলো গর্জনময়। শেখ মুজিবের হাতে গড়া এ সংগঠন ৭১-এর আগে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ছিলো জনতার প্রতিরোধের প্রতীক। ৯০-এর দশকে সামরিক শাসনের পতনের আন্দোলনেও তারা ভূমিকা রেখেছিলো বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা—এক সময়ের সে সংগঠনের নেতাকর্মীরা মুখোশ পরে গলির ভেতর দিয়ে দৌড়ে যায়, ৫৪ সেকেন্ডে মশাল জ্বালিয়ে নিঃশব্দে গায়েব হয়ে যায়। এটাই এখন তাদের ‘রাজপথ’।

কেন এ পতন? কারণ তাদের রাজনীতি থেকে আদর্শ উধাও হয়ে গেছে, জায়গা নিয়েছে দম্ভ, দখল, চাঁদাবাজি আর ক্ষমতার দাপট। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতার ছায়ায় থেকে ছাত্রলীগ পরিণত হয়েছিলো একটি ‘যুব কন্ট্রাক্টিং সংস্থা’ বা দানবে। নিয়োগ, টেন্ডার, বরাদ্দ—যেখানে সুবিধা ছিলো, সেখানেই তাদের উপস্থিতি। অথচ আন্দোলন, সংগঠন বা ছাত্রস্বার্থ—এসব ছিলো কেবল বক্তৃতার বিষয়।

ক্ষমতা হারালে রাজপথ হারায়

রাজনীতি যখন কেবল ক্ষমতার দখল বজায় রাখার মাধ্যম হয়, তখন সেটি রাজপথ হারায়। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তাদের নেতাকর্মীরা রাজপথে না নেমে ‘দফতরে’ রাজনীতি করেছে। প্রশাসনই হয়ে উঠেছিলো তাদের প্রধান অবলম্বন। পুলিশ ছিলো পার্টনার, আমলাতন্ত্র ছিলো ঢাল। এখন যখন সে ঢাল সরেছে, তখন তাদের একমাত্র ভরসা—রাজপথও—আর নেই।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের বক্তব্যটি হয়তো তিক্ত, কিন্তু নির্মম সত্য। তার ভাষায়—

কেউ কেউ ক্ষীণস্বরে গোপনে যেখানে ‘জয়’ বলে, তার এক মাইল দূরে গিয়ে ‘বাংলা’ বলে—এটাই আজকের আওয়ামী রাজনীতির প্রতীক। 

ভয়, অবিশ্বাস আর বিচ্ছিন্নতা তাদের এমন পর্যায়ে এনেছে, যেখানে রাজপথে একসঙ্গে দাঁড়ানোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।

৫৪ সেকেন্ডের সে মিছিল কেবল ছাত্রলীগের দুর্বলতা নয়, এটি গোটা ক্ষমতাধর রাজনীতির দেউলিয়া চিত্র। যে রাজনীতি ১৫ বছর ধরে প্রশাসনিক কর্তৃত্বের ওপর দাঁড়িয়েছিলো, সেটি এখন জনতার রাজপথে জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না।

রাজপথ কেনো গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজপথই রাজনীতির প্রাণ। ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১—সব আন্দোলন রাজপথেই জন্ম নিয়েছে। ৯০ সালে এরশাদের পতনও রাজপথে। রাজপথ মানে জনতার নাড়ি, জনগণের প্রতিক্রিয়া, গণতন্ত্রের চাপ। যে দল রাজপথ হারায়, সে দল জনগণ হারায়। ছাত্রলীগের ৫৪ সেকেন্ডের মিছিল দেখিয়ে দিয়েছে—

তারা কেবল রাজপথই হারায়নি, হারিয়েছে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও।

একসময় ছাত্রলীগের মিছিল মানে ছিলো প্রতিবাদের গর্জন। আজ সেটি ফেসবুক ভিডিওতে নিঃশব্দ আতঙ্ক। এটি রাজনৈতিক পতনের এক অনিবার্য লক্ষণ।

রাজনীতি থেকে আদর্শের নির্বাসন

রাজনীতিতে আদর্শ হারিয়ে গেলে সংগঠন টিকে থাকে কেবল কাঠামোগতভাবে—প্রাণহীন কঙ্কালের মতো। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সে অবস্থা বহু আগেই এসেছে। ‘দেশের জন্য কাজ করা’ নয়, বরং ‘দলের নাম ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা’ই হয়ে উঠেছিলো তাদের মূল লক্ষ্য। প্রশাসন, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল—সব জায়গায় তারা ছিলো প্রভাবশালী। কিন্তু সে ক্ষমতা ছিলো ভাড়া করা, স্থায়ী নয়। জনসমর্থন ছিলো না, ভয় ছিলো।

আজ সে ভয় উল্টে গেছে। এখন তারাই ভয় পায়। কারণ জনতার স্মৃতি ছোট হলেও ক্ষোভ দীর্ঘস্থায়ী।

ভয়, পরাজয় ও আত্মসমালোচনার সময়

আজ যারা ৫৪ সেকেন্ডের বেশি রাজপথে থাকতে পারছে না, তারা একসময় অন্যদের ৫ সেকেন্ডও থাকতে দিতো না। আজ সে সময়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে ইতিহাস। তবে এ প্রতিশোধ নয়—এটি আত্মসমালোচনার সময়। 

আরও পড়ুন <<>> রাজনীতিতে ’69’দের জয়জয়কার! ত্যাগীরা অসহায়

এ শিক্ষা গতানুগতিক সব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও। তারা যদি সত্যিকার অর্থেই রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে এখনই তাদের জনতার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে হবে। রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে ক্যাম্পাসে, ক্লাসরুমে, শ্রমিকের পাশে, কৃষকের মাঠে। ক্ষমতা হারানোর পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, সেটি পূরণ হয় কেবল জনগণের আস্থা দিয়ে, ভয় দিয়ে নয়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে এমন পরিণতি আর কাদের জন্য অপেক্ষা করছে কে জানে?

বাংলাদেশের রাজনীতির সার্বিক সংকেত

ছাত্রলীগের ৫৪ সেকেন্ডের মিছিল কেবল তাদের নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য এক সতর্কবার্তা। যারা ভাবছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী, যারা জনতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবল প্রশাসনের ওপর নির্ভর করছে, দলীয় পেশীশক্তির ওপর নির্ভর করছে, অবৈধ সম্পদের ওপর নির্ভর করছে—তাদেরও একদিন হয়তো এমন ৫৪ সেকেন্ডের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।

বিএনপি হোক, জামায়াত হোক, এনসিপি হোক, কিংবা অন্য কোনও দল—সবাইকে বুঝতে হবে, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়, জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণই রাজনীতির শক্তি।

শেষ কথা

৫৪ সেকেন্ডের ছাত্রলীগের মিছিল আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য যথেষ্ট। এটি প্রায় দেড় যুগের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক—যেখানে রাজনীতি হারিয়েছে দিকনির্দেশনা, সংগঠন হারিয়েছে সাহস, আর তরুণেরা হারিয়েছে বিশ্বাস।

এ মিছিল যদি আমাদের রাজনীতিবিদদের চোখ খুলে দেয়, যদি তারা বুঝতে পারে ক্ষমতার চেয়ে জনগণের ভালোবাসাই বড় শক্তি, তবেই হয়তো ৫৪ সেকেন্ডের এ ভিডিও ইতিহাসে এক শিক্ষা হিসেবে টিকে থাকবে। অন্যথায়, আগামী দিনে তাদের রাজনীতি শুধু রাজপথ নয়, ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যাবে।

লেখক ও সংবাদকর্মী

শীর্ষ সংবাদ:

পাঁচ অস্ত্রসহ গ্রেফতার লিটন গাজী সম্পর্কে সব জানালো পুলিশ সুপার
আনসার ভিডিপি ব্যাংকের ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ব্যবস্থাপক গ্রেফতার
লালমনিরহাটে স্বামী হত্যা মামলায় স্ত্রী ও পরকীয়া প্রেমিকের যাবজ্জীবন
ভোলাহাটে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে কলেজ শিক্ষকের মৃত্যু
সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দালাল চক্রের খপ্পরে
বাংলাদেশ সীমান্তে পঁচছে ৩০ হাজার টন ভারতীয় পেঁয়াজ
সুদের টাকার জন্য নোয়াখালীতে ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা, গ্রেফতার-১
ইমরান খান বেঁচে আছেন, দেশ ছাড়তে চাপ: পিটিআই
হাসিনা-রেহানা-টিউলিপের প্লট দুর্নীতি মামলার রায় আজ
শুরু হলো বিজয়ের মাস
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত
খালেদা জিয়ার খোঁজ নিতে হাসপাতালে জামায়াত সেক্রেটারি
স্কুল ভর্তির লটারি ১১ ডিসেম্বর
বিডিআরকে দুর্বল করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাতেই পিলখানা হত্যাকাণ্ড
ছয় উপসচিবের দফতর পরিবর্তন