ইসলাম প্রচারে হযরত শাহজালাল মুজাররাদ ইয়ামেনি (রহ.)

ইতিহাসের পাতায় ইসলাম প্রচারে যারা অসাধারণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শাহজালাল মুজাররাদ ইয়ামেনি (রহ.)। তার আগমন, কর্ম, ও প্রভাব আজো বাংলার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে গভীরভাবে বিরাজমান।
১৩শ শতাব্দীতে তিনি ইয়ামেন থেকে উপমহাদেশে আসেন এবং সিলেটে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
পরিচয় ও পূর্বজীবনঃ
হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পূর্ণ নাম ছিলো শাহ জালাল কুনীয়ত মুজাররাদ ইয়ামেনি (রহ.)। জন্মস্থান সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে, তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন তিনি ইয়ামেনের হাদরামাউত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও তাসাউফে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর আত্মিক সাধনা, বৈরাগ্যপূর্ণ জীবন ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের কারণে তাকে ‘মুজাররাদ’ (অবিবাহিত ও নির্জন সাধক) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ইসলাম প্রচারে তার আগমন ও ভূমিকাঃ
সিলেটে আগমন
তৎকালীন সিলেট অঞ্চলে হিন্দু রাজা গৌড় গবিন্দ মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন করছিলেন। এক মুসলিম পরিবার নবজাতকের আকিকায় গরু কোরবানি দিলে রাজার আদেশে পরিবারটিকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও বিতাড়িত করা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলার মুসলিম শাসক সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন অভিযানে যান, এবং এ যুদ্ধে সহায়তার জন্য শাহজালাল (রহ.) তার ৩৬০ সাথী আউলিয়া নিয়ে সিলেটে আগমন করেন।
গৌড় গবিন্দের পতন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠাঃ
১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল (রহ.) ও সৈয়দ নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে গৌড় গবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি ‘সিলেট বিজয়’ নামে পরিচিত। যুদ্ধশেষে মুসলমানরা সিলেটের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং শাহজালাল (রহ.) সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি একটি খানকাহ স্থাপন করেন, যেখান থেকে তিনি ইসলাম প্রচার ও আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন।
দাওয়াত দ্বীন প্রচারের কৌশলঃ
শাহজালাল (রহ.) কোনো বলপ্রয়োগ বা জোর জবরদস্তি ছাড়াই ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। তার ব্যক্তিত্ব, আখলাক ও চরিত্রের প্রভাবে বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি কেবল নামাজ, রোজা ও ইসলামের আনুষ্ঠানিক আচার শিক্ষা দেননি, বরং মানুষকে আল্লাহভীতির সঙ্গে জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন।
৩৬০ আউলিয়ার বিস্তারঃ
শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে আগত ৩৬০ আউলিয়া সিলেট ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। ফলে আজকের বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী ভারতের কিছু অঞ্চলেও ইসলামের প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
আরও পড়ুন <<>> ইসলামের দৃষ্টিতে অপবাদ দিয়ে হত্যার বিধান
হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক অবদানঃ
শাহজালাল (রহ.) ছিলেন একজন খাঁটি সুফি সাধক। তার জীবন ছিল দুনিয়াবি মোহবর্জিত, আত্মনির্ভরশীল ও আল্লাহর স্মরণে পরিপূর্ণ। তিনি বহু মুরীদ তৈরি করেন এবং তাদের মাধ্যমে ইসলামের তাসাউফি শিক্ষা ছড়িয়ে দেন। তার প্রবর্তিত আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে বহু মানুষ নৈতিকতা ও পবিত্রতার দিকে ফিরে আসে।
ওফাত ও স্মৃতিঃ
হযরত শাহজালাল (রহ.) ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তার মাজার সিলেট শহরের অন্যতম পবিত্র ও ঐতিহাসিক স্থান, যা প্রতিদিন হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর থাকে। এই মাজার ইসলামের ইতিহাস, তাসাউফ, ও বাঙালি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক মহামূল্যবান নিদর্শন।
শাহজালাল মুজাররাদ ইয়ামেনি (রহ.) কেবল একজন ধর্মপ্রচারক নন, বরং একজন আধ্যাত্মিক নেতাও ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায় কীভাবে আত্মিক পরিশুদ্ধি, নৈতিকতা, ও মানবিক গুণাবলি দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। আজো বাংলার ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে তার প্রভাব সুস্পষ্ট, এবং তিনি চিরকাল ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল তারকার মতো জ্বলজ্বল করবেন।
লেখক:
ধর্মীয় শিক্ষক
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। মিরপুর, ঢাকা।