তালেবানকে কাছে টানতে মরিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ইরান

বিশ্বের কোনও দেশ এখওে আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবুও আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ বাড়াতে মরিয়া ভারত, পাকিস্তান ও ইরান।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভূরাজনীতিতে তালেবান সরকার এখন এমন এক বাস্তবতা, যাকে উপেক্ষা করা কৌশলগত আত্মহত্যার শামিল—এ উপলব্ধিই দেশগুলোর কূটনৈতিক অবস্থান পাল্টে দিচ্ছে।
তালেবান: একঘরে নয়, বরং সক্রিয় খেলোয়াড়
সম্প্রতি তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি যেভাবে পাকিস্তান, চীন, ইরান ও ভারতের সঙ্গে বৈঠক ও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে—তালেবান আজ একঘরে নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
২১ মে বেইজিংয়ে পাকিস্তান ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেয়ার পাশাপাশি, এর আগেই তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এমনকি ভারতীয় দূতাবাস পুনরায় খোলার পর, মুত্তাকি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রীর সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেন—এটাই দুই দেশের মধ্যে তালেবান শাসনামলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগ।
ভারতের কৌশলগত পুনর্বাসন
তালেবান শাসনের প্রথম পর্যায় (১৯৯৬–২০০১) ভারত একেবারে সম্পর্কবিচ্ছিন্ন রাখে। সে সময় তালেবানকে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে বিবেচনা করতো নয়াদিল্লি। তালেবানবিরোধী ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ ছিল ভারতের প্রধান সহযোগী। কিন্তু এর ফলাফল হয়েছিলো উল্টো—আফগানিস্তানে পাকিস্তান একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে।
২০০১ সালে তালেবান পতনের পর ভারত প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশ নেয়, তবে ২০২১ সালে তালেবানের পুনরাগমনে ভারত আবার দূতাবাস বন্ধ করে। তবুও এবার ভারত আগের মতো কঠোরভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি।
২০২২ সালের মাঝামাঝিতে ভারত কাবুলে ‘কারিগরি মিশন’ নামে দূতাবাস আংশিক চালু করে। ২০২৪ সালে তালেবান ভারতে কনস্যুলেট নিয়োগ দেয়, যা দুই পক্ষের সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন করে।
বিশ্লেষক কবির তানেজা বলেন, ভারতের এ যোগাযোগ নিছক সমর্থনের লক্ষ্যে নয়, বরং আফগান ভূখণ্ড যেন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বা চীন ব্যবহার না করতে পারে, সে নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকেই।
পাকিস্তান: পৃষ্ঠপোষক থেকে প্রতিপক্ষ
তালেবানের জন্মকালীন ও পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলো পাকিস্তান। কিন্তু ২০২১ সালের পর থেকে তালেবান আশ্রিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর হামলায় পাকিস্তানে নিরাপত্তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান বহু আফগান শরণার্থী ফেরত পাঠায়, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়, এমনকি বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। তারপরও ইসলামাবাদ কূটনৈতিক বরফ গলাতে ইশাক দারকে কাবুল পাঠায়।
বিশ্লেষক রাবিয়া আখতার বলেন, এটা কোনো স্থায়ী সমঝোতা নয়। বরং ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার জেরে পাকিস্তান চাইছে, আফগানিস্তান যেন ভারতের দিকে না ঝুঁকে।
তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন অবশ্য বলেছেন, আমরা আমাদের দিক থেকে চেকপোস্ট স্থাপনসহ বহু পদক্ষেপ নিয়েছি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের নয়, তাদের কাজ।
ইরান: বিরোধ থেকে বাস্তবতার পথে
একসময় তালেবান ও ইরান যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো। ১৯৯৮ সালে ইরানি কূটনীতিক হত্যার পর ইরান সামরিক প্রস্তুতিও নেয়। কিন্তু এখন তালেবানের সঙ্গে ইরান নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
তিনটি প্রধান কারণ:
- হেলমান্দ নদীর পানি প্রবাহ – পূর্ব ইরানের জন্য অত্যাবশ্যক।
- আফগান শরণার্থী – কয়েক লাখ মানুষ ইরানে অবস্থান করছে।
- আইএস (Islamic State) হুমকি – তালেবান ও ইরান উভয়ের জন্য শত্রু।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান তালেবানকে স্বীকৃতি না দিলেও, বাস্তব নিরাপত্তা ও সীমান্ত স্বার্থে এখন কৌশলগত যোগাযোগ বজায় রাখছে। ইরানের চরমপন্থাবিরোধী অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতার কৌশলগত ভারসাম্যে তালেবান এখন প্রয়োজনীয় 'প্রতিপক্ষ-সখ্য' হয়ে উঠেছে।
‘অস্বীকৃত’ শাসক, অথচ কেন্দ্রে
জাতিসংঘ বা কোনও রাষ্ট্র তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু এ বাস্তবতা রাজনৈতিকভাবে পরিত্যাগ করাও এখন কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
ভারত, পাকিস্তান, ইরান—তিনটি পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রই এখন এক কৌশলগত প্রশ্নে ঐকমত্যে-‘তালেবানকে অগ্রাহ্য করলে চলবে না।’
তবে কে কতটা লাভ তুলতে পারবে এ অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক থেকে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, লাহোর ইউনিভার্সিটি
সবার দেশ/কেএম