রাত পোহালে ভোট: জাতীয় রাজনীতির ‘মিনি পার্লামেন্ট’ ডাকসু ফিরছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) একসময় ছিল দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র—একটি ‘মিনি পার্লামেন্ট’। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি বড় রাজনৈতিক ধাপে ডাকসুর নেতৃত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ সময় ধরে দলীয় প্রভাব, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং অনিয়মের কারণে ডাকসু তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুনভাবে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সে প্রত্যাশার মধ্যে আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।
ডাকসুর ইতিহাস ও নির্বাচন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। শত বছরের ইতিহাসে ৩৭ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে ডাকসুর নির্বাচন কেবল সাতবার হয়েছে।
প্রথম দিকে ডাকসুর কার্যক্রম ছিলো শিক্ষাবান্ধব এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ। শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাহিত্য প্রকাশনা, বিতর্ক ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা এবং ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজন ছিল মূল দায়িত্ব। ১৯৬০-এর দশকের প্রথমার্ধে এ ধারা বজায় ছিলো।

কিন্তু ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী সংগ্রাম এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ডাকসু ও ছাত্রসংগঠনগুলো সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বেড়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ডাকসুর নির্বাচন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন দশক পর ২০১৯ সালে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নানা বিতর্কে তা জর্জরিত হয়।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও উদ্বেগ
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদ হাসান বলেন,
দলীয় প্রভাব ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ডাকসু তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালের নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। নতুন নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই বারবার নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

গণযোগাযোগ বিভাগের মাইশা মালিহা বলেন,
ডাকসুর মূল লক্ষ্য ছিলো ছাত্রদের অধিকার, গণতান্ত্রিক চর্চা ও নেতৃত্ব বিকাশে সুযোগ সৃষ্টি করা। স্বাধীনতার পর এটি ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে পড়েছে। দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুল আলিম বলেন,
ডাকসু নির্বাচন বর্তমান ‘জুলাই স্পিরিট’-এর বাস্তবায়ন। এটি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি ও প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তবে শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
শিক্ষকদের বিশ্লেষণ
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভুঁইয়া বলেন,
ডাকসু নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভোটার। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরুণ সমাজ। তাই জাতীয় রাজনীতির প্রভাব কিছুটা প্রতিফলিত হলেও শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দে ভোট দেয়। নির্বাচিত প্রার্থীরা কখনও কখনও রাজনৈতিক দলকেই সেবা করে, আবার কখনো শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রধান্য দেয়। এ কারণে ডাকসুকে ‘মিনি পার্লামেন্ট’ বলা হয়।
ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবসময় জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। যারা ডাকসুতে ভালো ছাত্ররাজনীতি করে বিজয়ী হয়, তারা পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে ছিলো। যারা ফ্যাসিস্ট সরকার চালায় বা গণতন্ত্রকে দমন করে, তারা ডাকসুর ভয় পায়। নিয়মিত নির্বাচন হলে এ প্রভাব আরও দৃঢ় হবে।

ডাকসুর রাজনীতি ও জাতীয় প্রভাব
রাজনৈতিক দলগুলো ডাকসু নির্বাচনকে ভয় পায় কি না, এমন প্রশ্নে রাশেদ আলম ভুঁইয়া বলেন,
জাতীয় রাজনীতিতে কোনো দল ক্ষমতায় আসলেও ডাকসুতে তাদের ছাত্রসংগঠন জয়ী হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষার্থীরা নিজেরা যাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করে তাদের ভোট দেয়। ইতিহাসে দেখা যায়, ডাকসু নির্বাচনে প্রায় সব সময় বিরোধী দলের জয় হয়েছে। এ কারণে দলগুলো ডাকসুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের শক্তি ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা নির্বাচনে ভোট দিয়ে শুধু দলের জন্য ভোট দেয় না। তারা বিবেচনা করে প্রার্থীর স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও নৈতিকতা। এটি জাতীয় রাজনীতির জন্যও একটি পরীক্ষা, কারণ ডাকসুতে জয়ী শিক্ষার্থী পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রভাব রাখতে সক্ষম।
দীর্ঘ বিরতি, দলীয় প্রভাব এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের পর ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পুনর্জীবিত গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উদিত হচ্ছে। স্বচ্ছ ও বৈচিত্র্যময় নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসু আবার জাতীয় রাজনীতির ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসেবে ফিরে আসতে পারে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, দায়িত্ববোধ ও নৈতিক মূল্যবোধই নির্ধারণ করবে ডাকসুর ভবিষ্যৎ।
সবার দেশ/কেএম




























