শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পরিবর্তনের নেতৃত্বে
৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন আজ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ৩৫ বছর পর ব্যপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শিক্ষার্থীরা ফিরে পাচ্ছেন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ।
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ, যেখানে ২৭ হাজার ৫২১ জন শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
নির্বাচনী উত্তেজনা ও উৎসবমুখর পরিবেশ
গত কয়েকদিন ধরে চবি ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। শাটল ট্রেন, ক্যান্টিন, হল কিংবা কটেজ—সবখানেই শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত নির্বাচনী আলোচনা ও সম্ভাব্য বিজয়ীদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনায়। প্রচার শেষ হলেও উত্তাপ ছড়িয়েছে প্রতিটি করিডরে।
প্রার্থী ও প্যানেলের সংখ্যা
এবার কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০৮ জন প্রার্থী। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬টি পদে লড়ছেন ৪১৫ জন, আর হল সংসদে ৪৭৩ জন। পাশাপাশি হোস্টেল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২০ জন। মোট ১৩টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে এবারের নির্বাচনে।
ভিপি পদে ২৪ জন, জিএস পদে ২২ জন এবং এজিএস পদে ২১ জন প্রার্থী রয়েছেন। অন্যান্য পদে ১০ থেকে ২০ জন করে প্রার্থী লড়ছেন ক্রীড়া, সাহিত্য, সমাজসেবা, আবাসন ও সংস্কৃতি সম্পাদকীয় পদে।
নির্বাচনের ইতিহাস
১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়বার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষটি হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় পর সপ্তমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ নির্বাচন। ফলে প্রজন্ম বদলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা প্রবল।
নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রযুক্তিনির্ভর ভোট
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নতুন কলা ভবন, বিজ্ঞান অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান, বাণিজ্য অনুষদ ও আইটি ভবনে। ৬০টি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে ৭০০টির বেশি বুথ। দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিশেষ বুথের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রতিটি ব্যালটে থাকবে ২৪ ডিজিটের কোড ও একটি গোপন নিরাপত্তা কোড, যা ওএমআর প্রযুক্তির মাধ্যমে যাচাই করা হবে। প্রতিটি বুথে ভোট দেবেন ৪০০ থেকে ৫০০ জন শিক্ষার্থী।
ভোট প্রদানে সময় ও নিয়ম
প্রত্যেক ভোটার মোট ৪০টি ভোট দিতে পারবেন—চাকসুর জন্য ২৬টি এবং হল বা হোস্টেলের জন্য ১৪টি। এজন্য একজন ভোটারকে দেয়া হবে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময়। চার পৃষ্ঠার ব্যালটে নির্দিষ্ট কলম দিয়ে পূর্ণ বৃত্ত ভরাট করেই ভোট দিতে হবে।
আলোচনায় শীর্ষ প্রার্থীরা
ভিপি পদে আলোচনায় রয়েছেন ছাত্রদল সমর্থিত সাজ্জাদ হোসেন হূদয়, ছাত্রশিবির ঘনিষ্ঠ ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর ইব্রাহীম হোসেন রনি, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের মাহফুজুর রহমান, বাম ও পাহাড়ি প্যানেলের ধ্রুব বড়ুয়া (‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’), এবং ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’-এর মুহাম্মদ ফরহাদুল ইসলাম।
জিএস পদে আছেন রশিদুল হক দিনার (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন), সাঈদ বিন হাবিব (সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট), শাফায়াত হোসেন (ছাত্রদল), সাকিব মাহমুদ (ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিস সমর্থিত) এবং একমাত্র নারী প্রার্থী চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ (বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য)।
এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আইয়ুবুর রহমান তৌফিক (ছাত্রদল), সাজ্জাত হোসেন মুন্না (ছাত্রশিবির) ও জান্নাতুল ফেরদৌস (স্বতন্ত্র)।
নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ
এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ৪৭ জন নারী প্রার্থী। শীর্ষ তিন পদে মাত্র একজন নারী প্রার্থী থাকলেও হল ও সাংস্কৃতিক পদে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এজিএস পদে অংশ নিচ্ছেন ছাবেকুন নাহার ও জান্নাতুল ফেরদৌস।
নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি
চার স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএনসহ প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও মোতায়েন থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন জানিয়েছেন,
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে, কারচুপির সুযোগ থাকবে না।
চবি প্রক্টর অধ্যাপক হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী বলেন,
পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ কেন্দ্রে ঢুকতে পারবে না, বহিরাগতদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কাজী তারেক আজিজ জানান,
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
পরিবহনব্যবস্থা
শিক্ষার্থীদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য রাখা হয়েছে ৩০টি বাস এবং নগর থেকে চবিতে চলবে ১১টি শাটল ট্রেন।
শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা
ছাত্রদল সমর্থিত এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিককে সমর্থন জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ার হোসেন ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তৌফিক যোগ্য প্রার্থী, আমি একাডেমিক ব্যস্ততার কারণে সরে দাঁড়াচ্ছি, কোনো চাপের কারণে নয়।
শিক্ষার্থীদের আশা—পরিবর্তনের নেতৃত্ব
দীর্ঘ বিরতির পর এ নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ ও দায়িত্ববোধ নিয়ে অংশ নিচ্ছেন। তাদের প্রত্যাশা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ক্যাম্পাসের বাস্তব সমস্যা—আবাসন সংকট, শাটল ট্রেনের ভিড়, নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা ও খাবারের মান—সমাধানে ভূমিকা রাখবেন।
তারা এমন নেতৃত্ব চান, যারা দলীয় আনুগত্য নয়, বরং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করবেন—নিরাপদ, স্বাধীন ও শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস গঠনে নতুন অধ্যায় রচনা করবেন।
সবার দেশ/কেএম




























