ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে মধুমতি ব্যাংক
মধুমতি ব্যাংক, চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম, নিয়ম অমান্য ও পরিচালনা পর্ষদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপস্থিতির কারণে সমালোচনার মুখে। ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে ঋণ খেলাপি, অর্থপাচার এবং হত্যা মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখনও পদে বহাল আছেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
পরিচালনা পর্ষদে বিতর্কিত ব্যক্তিরা
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুমোদিত মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে এখনও রয়েছেন:
- চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর
- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল
- ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস (সাবেক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র)
- মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
- নিমাই কুমার সাহা
- সালাহউদ্দিন আলমগীর
- মোস্তফা কামাল (মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান)
- এ মান্নান খান (স্বতন্ত্র পরিচালক, ঋণ খেলাপি)
- তানভীর আহমেদ মোস্তফা
- মো. মাহবুবুর রহমান
- স্বতন্ত্র পরিচালক সৈয়দ রেজাউর রহমান
- স্বতন্ত্র পরিচালক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল
অনেক পরিচালক দীর্ঘদিন ধরে বোর্ড সভায় অংশ নিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো পরিচালক তিনটি পরপর সভায় বা তিন মাসের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার পদ শূন্য হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পরও পদে বহাল আছেন শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
ঋণ খেলাপি ও মামলা সংক্রান্ত তথ্য
- ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অর্থপাচারের মামলা রয়েছে।
- তার ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৫৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, ২৭টি ব্যাংক হিসাব থেকে ৫৩৮ কোটি টাকা ও ৫ লাখ ডলারের বেশি অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
মধুমতির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপির অভিযোগ উঠেছে, যা ব্যাংকিং খাতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, হুমায়ুন কবীর একটি নামমাত্র কোম্পানির মাধ্যমে শত কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেন, যা পরিশোধ করা হয়নি। ঋণখেলাপি হলেও মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করবে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে- হুমায়ুন কবীরের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন হ্যাচারির অনুকূলে এনআরবিসি ব্যাংকে বর্তমানে প্রায় ১১৩ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। আর উত্তরা ফাইন্যান্সে একই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা রয়েছে। নর্দার্ন হ্যাচারির পরিচালক হুমায়ুন কবীর।
এ বিষয়ে হুমায়ুন কবীর বলেন, আমার নামের মতোই আরেকজন আছেন তিনি হুমায়ুন কবির বাবলু। তাকে অনেক আগেই ব্যাংক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন কর্মচারী বলেন, একই ব্যক্তি কখনও হুমায়ুন কবীর কখনও-বা হুমায়ুন কবীর বাবলু নামে ডান-বাম হাতে সিগনেচার করে নয়-ছয় করছেন।
আইনগত ও নীতিমালা বিষয়ক খুঁটিনাটি
- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, নিয়ম ভেঙে কেউ পরিচালক পদে থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
- ঋণ খেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারেন না। তবে হত্যা মামলার আসামি হলেও চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত পদে থাকতে পারেন।
- গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ খেলাপি হলে তাকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার ও বিচার বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
পরিচালনা পর্ষদের অনলাইন কার্যক্রম
- গত ৫ আগস্টের পর অনেক পরিচালক আত্মগোপনে বা বিদেশে চলে গেছেন।
- অনলাইনের মাধ্যমে সভায় অংশ নেয়ার চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি অনুমোদন করেনি।
- হোয়াটসঅ্যাপ ও ই-মেইলে ছুটি আবেদন করে পরিচালক পদে থাকার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি
- ব্যাংকের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে আমানত ৮,০১১ কোটি টাকা।
- মোট ঋণ ৬৬৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৫৩ কোটি টাকা বা ২.৩০ শতাংশ।
- নিট মুনাফা ১২৬ কোটি টাকা।
- শাখা সংখ্যা ৫২, এটিএম ৪৭, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ৬৪৩। কর্মী সংখ্যা ৭৬০।
- বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের ‘ব্যাংকস হেলথ ইনডেক্স (বিএইচআই) অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ অনুযায়ী, ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে মধুমতি অন্যতম।
বিশ্লেষক মতামত
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ঋণ খেলাপি ও গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপস্থিতি ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ও নৈতিকতার জন্য প্রশ্ন উত্থাপন করছে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ না নেন, তাহলে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
সবার দেশ/কেএম




























