গ্রাহকের টাকায় হাত দিতে ভুয়া অ্যাকাউন্টের ফাঁদ
‘রিফান্ডে’র নামে আবারও ই-কমার্স প্রতারণা!
ভুয়া অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের টাকা তুলে নেওয়ার পাঁয়তারা। ভেরিফিকেশন করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ইস্যু করতে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে প্রতারণা। এবার ভুয়া ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্স অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে গ্রাহকের ফেরতযোগ্য অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা চলছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব ভুয়া অ্যাকাউন্টের পেছনে রয়েছে কুখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ও তাদের সহযোগী নেটওয়ার্ক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ২০টি অ্যাকাউন্ট ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় সেগুলো পেমেন্ট গেটওয়ের রিফান্ড তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের তথ্য ইভ্যালির পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিলো।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিফান্ড প্রক্রিয়ায় কঠোর যাচাইবাছাই শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে রিফান্ডের জন্য জমা পড়া সব অ্যাকাউন্ট যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে।
প্রতারণার নতুন কৌশল
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক জটিলতায় কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি ই-কমার্স প্রতারকদের কাছ থেকে গ্রাহকের অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে। সে সুযোগেই ইভ্যালি, দালাল প্লাসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের নামে অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠানো হয়—যাতে সে অ্যাকাউন্টে রিফান্ড পাঠানো যায়।
যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায়, ইভ্যালি পাঠানো ১৬৩টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ২০টির সঙ্গে সরাসরি কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অর্থাৎ গ্রাহকের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ইভ্যালি নিজেরাই সে অর্থ তুলতে চেয়েছিলো।
এ ঘটনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ জানায়, রিফান্ডের জন্য দেয়া সব অ্যাকাউন্ট যেনো গ্রাহকদের নিজস্ব হিসেবে আছে কি না তা যাচাই করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, অ্যাকাউন্ট যাচাই একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই গ্রাহকের অর্থ ফেরতের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT) না করে ‘অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক’ বা পে-অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা ফেরত দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রাশেদ বলেন, অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে যার নাম থাকবে, কেবল তিনিই তার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে তা জমা দিতে পারবেন। এতে ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণা রোধ করা সম্ভব।
গ্রাহকের টাকার হিসাব কোথায়?
ই-কমার্স প্রতারণায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হলেও তার অধিকাংশ টাকার কোনো সঠিক হিসাব দিতে পারেনি ইভ্যালি, দালাল প্লাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়—
- ইভ্যালি মাত্র ২১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে, যা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
- কিউকম ফেরত দিয়েছে প্রায় ৩৮৪ কোটি টাকা,
- আলেশা মার্ট ৪১ কোটি টাকা,
- এবং দালাল প্লাস প্রায় ২৩ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেলের তথ্য অনুযায়ী, ইভ্যালির গ্রাহকদের প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি এখনও বিভিন্ন ব্যাংক ও পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে। এছাড়া কিউকমের ১০ কোটি, দালাল প্লাসের ৯ কোটি ৮৬ লাখ এবং আলেশা মার্টের ২ কোটি টাকার বেশি অর্থ ফেরত প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শতাধিক অ্যাকাউন্ট যাচাইয়ের পর কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্ট বাদ দেয়া হয়েছে, বাকিগুলোর রিফান্ড প্রক্রিয়া চলছে।
ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় ‘ডিজিটাল বাণিজ্যের স্বপ্ন’ দেখিয়ে লাখো গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলো। এখন সে টাকাই ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ায় আবারও প্রতারণার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারকে একটি স্বচ্ছ ও কেন্দ্রীভূত ই-কমার্স তদারকি কাঠামো গঠন করতে হবে—যেখানে প্রতিটি লেনদেনের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই ও ট্র্যাক করা যাবে। না হলে, ‘রিফান্ডের নামে’ আরও বড় অর্থ পাচারের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
সবার দেশ/কেএম




























