দুদকের অনুসন্ধান
আনিসুলের ‘বান্ধবী’ তৌফিকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়

সিটিজেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান তৌফিকা করিম ওরফে তৌফিকা আফতাবেরর নামে ৫৬ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ৪০ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ ও ১৮ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি।
তৌফিকা করিমের পরিচিতি রয়েছে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের এক পরিচালক।
তৌফিকার পাশাপাশি তার স্বামী আফতাবুল ইসলাম—বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক—এর বিরুদ্ধেও পৃথক অনুসন্ধান চলছে।
আদালতে ‘নেপথ্য শক্তি’ হিসেবে প্রভাব
তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৎকালীন আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিচার বিভাগে অঘোষিত প্রভাব গড়ে তোলেন তৌফিকা করিম। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় জামিন ও রায়ের পেছনে প্রভাব খাটান, এমন অভিযোগ রয়েছে।
বিপুল সম্পদের খোঁজ
দুদক ইতোমধ্যে তৌফিকার ৩৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে, যেখানে প্রায় ৪৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকার স্থিতি মিলেছে।
- বসুন্ধরা আবাসিকে ৬ কোটি টাকার বেশি মূল্যের একটি বিলাসবহুল বাড়ি
- ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও সিটিজেন ব্যাংকে ২৩ কোটি টাকারও বেশি অর্থ
- সিটিজেন ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার শেয়ার
- পাশাপাশি এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ৪০% শেয়ার ও নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি
সিটিজেন ব্যাংকে উঠে আসার গল্প
জানা যায়, সিটিজেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকা জামানত ও ২০০ কোটি টাকার কার্যকর মূলধন সরবরাহ করেন। প্রথমে তার মা চেয়ারম্যান হলেও পরে মৃত্যুর পর তৌফিকা করিমকে চেয়ারম্যান করা হয়। ব্যাংকের পাশাপাশি বিচার বিভাগের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৌফিকাই হয়ে ওঠেন আনিসুল হকের ছায়া-শক্তি।
রাজনৈতিক পতনের পর পদত্যাগ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর, ১৯ সেপ্টেম্বর তৌফিকা সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছাড়েন, এরপর তাকে টেলিভিশন চ্যানেল থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়।
কোটি কোটি টাকার রায়ের বাণিজ্য
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, আইনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী অ্যাডভোকেট রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন তদবির নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হলে সে আর্থিক লেনদেনের দায়িত্ব তৌফিকা নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি আইনমন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে জামিন ও রায়ের গ্যারান্টি দিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করতেন, এমন অভিযোগও তদন্তে উঠে এসেছে।
বিতর্কিত বিচারপতি নিয়োগ, সাব-রেজিস্ট্রার বদলি, জেলা জজ পদায়ন—এসব ক্ষেত্রেও তৌফিকার সম্পৃক্ততা এবং ‘প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার’ নামে সুপারিশপত্র থাকার অভিযোগও তদন্তে এসেছে।
বিদেশে পাচার?
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তৌফিকা ও আনিসুল হক গত এক দশকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন—এমন অভিযোগ রয়েছে, যদিও এখনও পূর্ণ প্রমাণ মেলেনি।
তৌফিকার পুত্র কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং সেখানে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তৌফিকার স্বামীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও তার বেনামি বিনিয়োগ রয়েছে বলে সন্দেহ করছে দুদক।
পরবর্তী পদক্ষেপ
দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান দলের প্রধান জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খুব শিগগিরই তা কমিশনে দাখিল করা হবে।
এছাড়াও অর্থ পাচারের অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আলাদা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
সবার দেশ/কেএম