ভারতে নিষিদ্ধ ওষুধ আসছে দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্ত পথে
ফেনসিডিলের বিকল্প ‘উইন কোরেক্স’, নেশায় বুঁদ যুবসমাজ
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত পথে ফেনসিডিলের বদলে আসছে ‘উইন কোরেক্স’। এ সিরাপ মূলত শুষ্ক কাশির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে ফেনসিডিলের মতোই নেশা হওয়া ও দাম কমের কারণে এ সিরাপের দিকে ঝুঁকছে সেবনকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেনসিডিলের দাম এখন প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো। আর ‘উইন কোরেক্স’ মিলছে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে। ফলে নেশা করতে এক শ্রেণির মানুষ সেটা কিনছে। তাই আগে যারা ফেনসিডিলের কারবার করতেন, তাদের অনেকেই এখন নতুন এ ‘মাদক কারবারে’ জড়িয়েছেন। বাংলাদেশে তুলনামূলক কম পরিচিত হওয়ায় কাশির সিরাপ পরিচয় দিয়ে এ মাদক নিয়ে আসছেন তারা। ওষুধ প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে ভারত থেকে এগুলো নিয়ে আসা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ফেনসিডিল ও ‘উইন কোরেক্স’ মূলত একই জিনিস। দুটিই কোডিন ফসফেট মিশ্রিত। ভিন্ন নামের কারণে মাদকসেবীরাও এটার দিকে ঝুঁকছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন,
এ মাদক সেবনে গলাবুক শুকিয়ে আসে, ঝিমুনির মতো হয়ে থাকে। এটি সেবনে কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে পড়ে। আরেকটি বড় ক্ষতির দিক হচ্ছে, দীর্ঘদিন সেবনে পুরুষের প্রজননক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
ভারতের ল্যাবোরেট ফার্মাসিউটিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাশির ওষুধ হিসেবে এ সিরাপ তৈরি করে। তবে নেশাদ্রব্য হিসেবে বহুল ব্যবহারের কারণে ভারতে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ হলেও এর উৎপাদন বন্ধ হয়নি। ভারতে উৎপাদিত এ নিষিদ্ধ ওষুধ এখন বাংলাদেশে ঢুকছে।
গত ১ নভেম্বর রাতে খুলনায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ঘরের খাটের নিচ থেকে ২২ বোতল কোডিন ফসফেট যুক্ত উইন কোরেক্স উদ্ধার করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খালিশপুর থানাধীন নুরনগর মেইন রোড সংলগ্ন জনৈক আকবর মুন্সির বাড়িতে অভিযান চালায়। এসময় ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. আবুল কালাম সরদারের (৩৫) ঘরের খাটের নিচ থেকে ২২ বোতল কোডিন ফসফেট যুক্ত উইন কোরেক্স উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মো. আবুল কালাম সরদারকে আটক করা হয়। সে বরিশালের নলছিটি উপজেলার ভাঙ্গা দেওলা গ্রামের মরহুম আমির আলী সরদারের পুত্র।
কেএমপির মিডিয়া সেলের ইনচার্জ সহকারী পুলিশ কমিশনার খোন্দকার হোসেন আহম্মেদ ওই সময় সাংবাদিকদের বলেন, আটককৃত আবুল কালাম সরদার নগরীর নুরনগর মেইন রোড এলাকার মো. আকবর মুন্সির বাড়িতে ভাড়াটিয়া থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ খুলনা মহানগর এলাকায় মাদকদ্রব্য কোডিন ফসফেট যুক্ত উইন কোরেক্স ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ করে আসছে। তার বিরুদ্ধে খালিশপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, গত ১৬ মে সাতক্ষীরায় ডিবি পুলিশের অভিযানে ৫০ বোতল উইন কোরেক্সসহ রাসেল হোসেন (২৪) নামে একজন আটক হয়। এগুলো ভোমরা সীমান্ত থেকে আটক করে পুলিশ।
সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি নিজাম উদ্দীন মোল্লা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভারত থেকে চোরাপথে উইন কোরেক্স নিয়ে আসা হয়েছিলো। ফেনন্সিডিলের বিকল্প মাদক হিসেবে এগুলো সেবন করা হয়।
অন্যদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত পথে উইন কোরেক্স ঢুকলেও যশোরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এখনও এ নেশার ওষুধ ধরা পড়েনি। জানতে চাইলে যশোর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক আসলাম হোসেন জানিয়েছেন, আমরা নতুন করে উইন কোরেক্স’র নাম শুনেছি। কিন্তু এখনও যশোর জেলায় উদ্ধার বা জড়িত কাউকে আটক করা হয়নি। যদিও জেলার বিভিন্ন স্থানের সোর্সসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সকল সদস্যদের উইন্স কোরেক্সের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। সন্ধান পাওয়া মাত্রই বিক্রেতা বা সেবী যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, এ দেশে কোডিন একেবারে নতুন মাদক নয়। ২০১০ সাল থেকেই এটা আসছে। তবে বছর দেড়েক ধরে এ মাদকের চালান বেশি আসছে। এর প্রতি মাদক সেবনকারীদের আগ্রহ বাড়ায় দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) ভোরে য়শোরের শার্শা উপজেলার কায়বা ও গোগা সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোট ৫০৭ বোতল সিরাপ উদ্ধার করা হয়।খুলনা ব্যাটালিয়ন (২১ বিজিবি) এর সদস্যরা পৃথক অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় ‘উইন কোরেক্স’ সিরাপ আটক করেছে।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, খুলনা ব্যাটালিয়নের অধীনস্থ কায়বা বিওপি ও গোগা বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় সীমান্তবর্তী একটি স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় ভারতীয় ‘উইন কোরেক্স’ সিরাপের বোতলগুলো পাওয়া যায়। তবে কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
খুলনা ব্যাটালিয়ন ২১ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ খুরশীদ আনোয়ার, পিবিজিএম, পিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স জানান,দেশের সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালানসহ যেকোনো ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিজিবির এ ধরনের অভিযান নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয়রা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় মাদক প্রবেশের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণে বিজিবির তৎপরতা আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেশা করা এক যুবক বলেন, ইয়াবা ও মদ পানের খরচ বেশি। সেখানে অল্প দামে কফ সিরাপ কিনে কাজ সেরে ফেলা যায়। প্রকাশ্যে সিরাপ খেলেও সাধারণত কেউ সন্দেহ করেন না। সিরাপ শরীরে যাওয়ার পরে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। মনে হয় যেন একটা আলাদা জগতে চলে গিয়েছি। কেউ শুধু সিরাপ খেয়ে নেশা করে।
ফেনসিডিল এক বোতল চার হাজার টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। সেখানে ৯শ থেকে ১ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে উইন কোরেক্স। তাই অধিকাংশ মাদকসেবী বিকল্প নেশার দিকে ঝুঁকছেন।
সবার দেশ/কেএম




























