মাটির ঘরে বাস করা এক ব্যতিক্রমী জীবনের অবসান
‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুখিকার মৃত্যু

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের ইতি ঘটল। উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুখিকা ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। সারাজীবন সাদাসিধে জীবনযাপন করে যিনি ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তার মৃত্যুতে শোক ছড়িয়ে পড়েছে শুধু লাতিন আমেরিকায় নয়, বিশ্বজুড়ে।
মুখিকা দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যনালির ক্যান্সারে ভুগছিলেন, তবে তার মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু অরসি এক্সে (সাবেক টুইটার) শোকবার্তায় লিখেছেন, আমাদের জন্য যা করেছো, তোমার মানুষের প্রতি ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ।
বিপ্লবী থেকে রাষ্ট্রনায়ক:
হোসে মুখিকার জীবন এক জীবন্ত উপাখ্যান। তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন বামপন্থি সশস্ত্র সংগঠন ‘টুপামারোস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে একাধিকবার বন্দি হন, গুলিবিদ্ধ হন, দুইবার জেল থেকে পালান এবং পরবর্তীতে টানা ১৪ বছর অমানবিক বন্দিজীবন পার করেন, যার অনেকটা সময়ই কনক্রিটের একক কক্ষে।
তিনি একবার বলেছিলেন, জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। প্রেসিডেন্ট হওয়া নয়।
রাষ্ট্র পরিচালনায় এক বৈপ্লবিক মুখ:
২০০৫ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০১০ সালে ৭৪ বছর বয়সে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে উরুগুয়ে চালু করে গর্ভপাত বৈধতা, সমলিঙ্গ বিবাহের স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত গাঁজার বাজার—যা উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য ছিলো নজিরবিহীন।
নামমাত্র সম্পদে রাষ্ট্রপ্রধান:
অন্য যেকোনও রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে আলাদা মুখিকা প্রেসিডেন্ট হয়েও থাকতেন রাজধানীর বাইরে নিজের ছোট্ট মাটির ঘরে। সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী লুসিয়া, যিনি নিজেও একজন সাবেক সেনেটর। চলাফেরা করতেন তার পুরনো নীল রঙের ভক্সওয়াগন বিটলে। নিজের বেতনের প্রায় ৯০% দান করে দিতেন দাতব্য সংস্থায়।
একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমাকে কেউ কেউ দরিদ্র প্রেসিডেন্ট বলে, আমি বলি, যারা সবসময় আরও চায়, তারাই আসল দরিদ্র।
কিছু বিতর্ক, কিন্তু অটল নীতি:
যদিও মুখিকার জনপ্রিয়তা ছিলো প্রায় ৭০ শতাংশ, তবে শিক্ষা খাতে প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং সরকারি ব্যয়ের বিস্তার নিয়ে কিছু সমালোচনা ছিলো। তবে তিনি কখনও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হননি এবং গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি।
২০২০ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ২০২৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘোষণা দেন এবং মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে বলেন, মৃত্যু জীবনের মতোই স্বাভাবিক। হয়তো মৃত্যু জীবনের লবণের মতো—প্রকৃত স্বাদটা এনে দেয়।
এক জন নেতা চলে গেলেন, রেখে গেলেন সততা, বিনয় আর মানবিকতার রাজনৈতিক আদর্শ।
হোসে মুখিকার মৃত্যুতে রাজনীতি হারাল এক নীরব বিপ্লবীকে, যিনি জীবনের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়ে গেছেন—ক্ষমতা নয়, মনুষ্যত্বই সর্বোচ্চ মূল্য।
সবার দেশ/কেএম