Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:০৭, ১৮ মে ২০২৫

আপডেট: ০০:১০, ১৮ মে ২০২৫

প্রবন্ধ

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর
ছবি: সবার দেশ

(শেষ পর্ব)

কোরআন তাই শাশ্বত, চিরন্তন, অকাট্য ও অপরিবর্তনীয় বিধায় সঠিক পথে চলার সংবিধান বিশ্ব মানবতার চির শান্তির অকাট্য দলিল। হযরত (স.)- এর নির্দেশে যায়েদ-বিন-সাবিত এবং কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী চামড়া, তালপাতা, কাগজের টুকরো কিংবা ছাগলের কাঁধের হাড় ইত্যাদির উপর সূরাসমূহ লিখে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরে তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-এর আমলে ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে যায়েদ-বিন-সাবিতের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। সে কমিটি কর্তৃক কোরআন বিশুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করে চূড়ান্ত করা হয়েছে। অন্তঃসলীলা কোরআনুল কারীমের পরতে পরতে প্রকাশ্য অর্থের অভ্যন্তরে রয়েছে এক পরমার্থের জগত। 

কোরআনের অনেক অক্ষর, শব্দ, বাক্য ও ভাবের ধ্বনিগত অর্থ ছাড়াও রয়েছে তত্ত¡গত মান, অর্থ, গুণ ও নির্ভুল গাণিতিক হিসেব-নিকেশ। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, 'নুর' শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো 'জ্যোতি' বা ‘আলোক'। অথচ, আল্লাহ্পাক কোরআনুল কারীমে ‘নুর' শব্দটি একবারও ‘জ্যোতি' বা 'আলোক' অর্থে ব্যবহার করেননি। ৪, ৫, ৬, ৯, ১০, ২৪, ৫৭, ৬১ ও ৬৬ নং সূরায় 'নুর' শব্দটি 'কোরআন', ‘রাসূল' ও ‘জ্ঞানলোক' হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সূরায়ে বাক্বারাহ্-এর অদ্যাক্ষর ‘আলীফ্-লাম্‌-মীম্'-এর অধ্যাততত্ত¡ অদ্যপি অধরাই রয়ে গেছে। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে কোরআন নাযিল শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। উনবিংশ শতাব্দির বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো কম্পিউটার প্রযুক্তি। আধুনিক কম্পিউটারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে (১৩০০ বছর পর) কোরআনের অক্ষরতত্ত¡ ও সংখ্যাতত্ত¡ স্থাপন করলে তা থেকে অলৌকিক ও বিস্ময়কর হিসেব-নিকেশ বের হয়ে আসতে শুরু করে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা চালিয়ে গেলে একদিন হয়তো সূরায়ে বাক্বারাহর বর্ণালী ভেদ করে ‘আলীফ্-লাম-মীম্-এর সুপ্ত জগতের গুপ্ত রহস্য বের হয়ে আসতে পারে। যা বের হয়ে আসলে মাখলুকাতের কোনো কোনো হিসেব-নিকেশের খাতায় শুরু হয়ে যেতে পারে নতুন অধ্যায়।

রাসূল করীম (সা.)-ও তাঁর জীবনে অনেক রূপক শব্দ ব্যবহার করেছেন। রাসূল (সা.))-এর বিবিদের মধ্যে দীর্ঘকায় ছিলেন বিবি জয়নব (রা.)আর খর্বাকার ছিলেন হযরত ওমর নন্দিনী বিবি হাফসা (রা.)। বিবিদের এক প্রশ্নের উত্তরে নবী (স.) “আমার বিবিদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে লম্বা সে আগে স্বর্গে প্রবেশ করবে।” এ কথা শ্রবণ করার পর দীর্ঘতনু বিবি জয়নব (রা.) পুলকিত হলেও মর্মাহত হন খর্বতনু বিবি হাফসা (রা.)। তাঁদের পুলকিত ও মর্মাহত হওয়ার বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর কর্ণগোচর হওয়ার পর বিবিগণের মধ্যে দান-খয়রাত বিষয়ে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিলেন-বিবি জয়নব (রা.) নন- বিবিদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্বর্গরোহণ করবেন বিবি হাফসা (রা.)। এখানে রাসূল (সা.) ‘লম্বা' বিশেষণটি স্বাভাবিক অর্থে গজ-ফুট-ইঞ্চি হিসেবে না বুঝিয়ে রূপক অর্থে ‘দান-খয়রাতের হাত' কে বুঝিয়েছেন। রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় যদি ‘লম্বা' বিশেষণের রূপকটি উম্মোচন করে না যেতেন তবে তা নিয়ে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যেতো। এমনিতেই খর্বতনু মেয়েরা অবহেলিত, তার উপর খর্বতনুটা স্বর্গারোহণের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে পড়লে-এ ভুলের দায় কে বহন করতো?

উপরের ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পবিত্র কোরআনের অক্ষর, শব্দ, বাক্য, দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলন সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে রূপ, রস ও গূঢ়-তত্ত¡ নিয়ে চলে বহুরূপের খেলা। আর এ কারণেই-এক আল্লাহর বান্দা, এক নবীর উম্মত এবং এক সংবিধান (কোরআন)-এর অনুসারী হয়েও আজ আমরা ছয় ডজন উপধর্মে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। ক'দিন আগেও যেখানে রাসূল (সা.) কে সবাই দাঁড়িয়ে ক্বিয়াম করতো এখন সেখানে একদল মুসলমান আল্লাহর মূল্য থেকে রাসূল (সা.) এর মূল্য অনেক বেশি পড়ে যায় অজুহাত তুলে বসে ক্বিয়াম করতে শুরু করে দিয়েছে। ফলে, কোরআনের জায়গায় কোরআনকে অক্ষত রেখে ইসলাম ধর্ম সম্প্রদায়ে নতুন আরো একটি উপদল বা ফেরকার জন্ম হলো। নিত্যের ঘর্ষণে পাথর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার বিষয়টি যেমন টের পাওয়া যায় না- তেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না আমাদের ধর্ম পদ্ধতি থেকে রাসূল (সা.)-এর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও। একদিন এ প্রশ্ন উঠতেই-পারে, যার কাছে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, যার নেই দেয়া-নেয়ার ক্ষমতা এবং যাকে উপলক্ষ্য করাই গুণাহের কাজ, তাকে আর মনে রেখে লাভ কি?
এবার পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রিয় কবি যাযেদ বিন সাবিতের হাতের লেখা কোরআনটি কেমন ছিল কোথায় ছিল-আর বর্তমানে কোথায় আছে বলতে পারো?
- জ্বী না।
- তবে শোনো, হযরত ওসমান (রা.)-এর আমলে যায়েদ-বিন-সাবিতের হাতের লেখা কোরআন এবং হযরত (স.)-এর সময়ে সংরক্ষিত কোরআন যা রাসূল (স.)-এর স্ত্রী খলিফা ওমরের কন্যা বিবি হাফসার (রাঃ) গৃহে সুরক্ষিত ছিল সেই কোরআন শরীফের সাথে মিলানো হয়। অমিল, সামঞ্জস্যবিহীন এবং অপ্রমাণিক সমস্ত কপি ভস্মীভ‚ত করা হয়। সংশোধিত মূল কপিটি সংরক্ষিত ছিল স্বয়ং খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-এর কাছে। কোরআন ভস্মীভ‚ত করাসহ স্বজনপ্রীতির বিষয় নিয়ে বিদ্রোহীরা তাঁর গৃহে প্রবেশ করে কোরআন পাঠরত অবস্থায় ৮২ বছর বয়ষ্ক বৃদ্ধ খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-কে নির্মমভাবে হত্যা করে।

-আমার শিক্ষকতাকালে সম্ভবত ১৯৭৭ - ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক তারিখে দৈনিক 'আজাদ' কিংবা 'ইনকিলাব' পত্রিকায় যায়েদ-বিন-সাবিতের হাতের লেখা কোরআনের একটি পৃষ্ঠা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত পৃষ্ঠায় হযরত ওসমান (রা.) শহীদবরণ কালে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। আততায়ীদের হাতে শহীদ হওয়ার আগে হযরত ওসমান (রা.)-এ কোরআনটি পাঠরত ছিলেন বলেও দাবি করা হয়। খলিফা ওসমান (রা.)-এর পর পর্যায়ক্রমিকভাবে হাত বদল হতে হতে মুসলমানগণ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সময়ও আব্বাসীয় শাসকের হাতে ছিল এ কোরআনের পান্ডুলিপিটি। ক্রুসেডের যুদ্ধে মুসলমানগণ কর্তৃক দখলকৃত কিছু রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার সময় সে কোরআনটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। মুসলমানদের হাতছাড়া হওয়া উল্লেখিত কোরআনটি কিনা বর্তমানে রাশিয়ার কোনো এক যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। আমি উক্ত পৃষ্ঠাটি পত্রিকা থেকে কেটে বাঁধাই করে রেখেছিলাম। মুকাত্তাআত (নক্তা বিহীন) আরবি অক্ষর দিয়ে লেখা বাঁধাইকৃত পৃষ্ঠাটি অনেককে পড়তে দিয়েছিলাম।

যারা ভালো আরবি পড়তে জানে তাদের একজনও পড়তে পারেনি। যতদূর জানা যায় নবী করিম (স.)-এর আমলের মুকাত্তাআত অক্ষরে লিখিত কোরআনুল করিমের মূল ভাব ভাষা, বর্ণ ও শব্দ অপরিবর্তিত রেখে সম্ভবত উমাইয়া আমলে আবশ্যকীয় নক্তা লাগানো হয়েছে। নক্তা বিহীন চৌদ্দ'শ বছর আগের হাতের লেখা বর্তমানে দুর্বোধ্যই হওয়ার কথা। কারণ, একজন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও মধ্যযুগের (দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী) বাংলা হাতের লেখা পাঠ করতে পারে না। নদীর মতো ভাষাও পরিবর্তনশীল। বিশিষ্ট ভাষাবিদগণ পুরানো আমলের বাংলাকে আধুনিক বাংলায় রূপান্তরের পর প্রাচীন বাংলা ভাষা সবার পাঠযোগ্য হয়। 

পুরাকালের হাতের লেখা কোরআনটিও হয়তো কোনো আরবি ভাষা পন্ডিতের হাতে হাল নাগাদ হওয়ার পর সকলের পাঠযোগ্য হয়েছে। একই কারণে বাংলায় অনূদিত বাইবেলের ভাষাও মোলায়েমভাবে পাঠযোগ্য না হওয়ায় সর্বসাধারণের কাছে তেমন সমাদৃত হচ্ছে না। অপরাপর ভাষার মতো আরবি ভাষাও পরিবর্তিত হচ্ছে। তিল তিল করে পরিবর্তনের কারণে শ' কিংবা হাজার বছর পর ভাষাকে যুগোপযুগী ও হাল-নাগাদ করতে হয়।

বর্তমানে আমাদের দেশে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক পায় ওলামা- এলেমগণ। তাদের অনেককে দিয়ে খুব সহজেই পছন্দ মতো ফতোয়া আদায় করা যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ক্রীড়নক হিসেবেও অনেককে ব্যবহার করা যায়। যেমন, ইংরেজ তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আবদুল ওহাবকে দিয়ে ধর্মের ভেতর যে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তাতে সফলও হয়েছে। একই কারণে আলিয়া মাদ্রাসায় বাংলাভাষী মাওলানাদের মাতৃভাষার পরিবর্তে বাধ্যতামূলকভাবে অমাতৃভাষা শিক্ষা দানের মাধ্যমেও তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছে। এখন এমন কোনো স্থান নেই যেথানে ওহাবী ভাবধারা প্রবেশ করেনি। বাংলাদেশের বর্তমান বুজুর্গদের মধ্যেও কেউ রক্ষণশীল, আবার কেউ আধুনিক। মিলাদ মাহফিল চলাকালে মিলাদের একাংশ ‘ইয়ানবী সালামু আলাইকা' বলে দাঁড়িয়ে গেছে আর অপর অংশ বসে রয়েছে বা মিলাদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এ হলো বাস্তব চিত্র।

মহামহিমান্বিত কোরআনুল করিম তিল মাত্র পরিবর্তনের আবশ্যকতা নেই ও সম্ভব নয়। আধুনিকায়নের নামে কিংবা কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের যেকোনো একটিকে অত্যধিক হাইলাইট করার নামে অপরগুলো কুয়াশাচ্ছন্ন করার দ্বারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিন্দু বিন্দু পরিবর্তন ক্রমেই সিন্ধুর দিকে যাচ্ছে। একটু একটু করে মুসলিম ব্রেনে হজম হতে শুরু হয়ে গেছে। আর এসব বিষয় নিয়ে কেউ 'টু' শব্দটিও করবে না। তবে কখনো কখনো ব্রেনে বদহজম হয়ে বিপরীত কান্ডও ঘটে যেতে পারে।

- ব্রেনে হজম-বদহজম এবং বিপরীত কান্ড এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না।
- পারবে পারবে, সময় হলে সব বুঝতে পারবে। বদহজম অর্থ পরিপাকক্রিয়ায় গÐগোল। কেউ জোর করে কোনো অখাদ্য-কুখাদ্য কারো উদরে প্রবেশ করালে কিংবা ভুলক্রমে উদরে প্রবেশ করে গেলে পরিপাকক্রিয়ায় গÐগোলের কারণে উদর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা উদগিরণ করে দিতে চেষ্টা করে। ব্রেনের খাদ্য হলো 'জ্ঞান'। কারণে-অকারণে অখাদ্য- কুখাদ্যের মতো কোনো দুর্বুদ্ধি কুবুদ্ধি ব্রেনে ঢুকে পড়লে ব্রেনের বেলায়ও উদরের মতো হজম-বদহজমের ঘটনা ঘটতে পারে। এখন আমরা ঘোরের মধ্যে আছি। জোর করে মোড় দিলেই ঘোর কাটে। ঘোর কাটলেই মূল কেটে ফুল পুজোর বুযুগি টের পাওয়া যাবে। তখন পরিকল্পিত উপায়ে জোর করে ব্রেনের ভেতর প্রবেশ করানো জ্ঞান হজম করার মতো হলে হয়তো হজম হবে নয়তো বদহজম হয়ে উদগিরণ আরম্ভ হলে ব্রেনের জীর্ণ-অজীর্ণ সব কৌশল বের হয়ে তখত্তাউস নোংড়া করে ফেলবে।

স্রষ্টার অসাধ্য কোনো কাজ নেই। সৃষ্টির স্বাভাবিক গতিধারা, প্রাকৃতিক ঘটনা ও সাধারণ নিয়মাবলির উপর স্রষ্টা কখনো হস্তক্ষেপ করেন না। স্রষ্টার কাজ অনেকটা ‘একদিন চাবি মাইরা দিলাম ছাইড়া জনম ভইরা চলিতেছে' মরমী গানের কলির মতো। কিন্তু স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির উপর একেবারেই হস্তক্ষেপ করেন না এ কথা মোটেও ঠিক নয়। যেমন, সুকৌসলে সীমালঙ্ঘনকারীদের প্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে নূহ্ নবী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের বাঁচিয়ে দিয়ে, মুসা (আ.)-কে বাঁচানোর জন্য নীলনদের পানি ক্ষণিকের জন্য শুকিয়ে, আবার পূর্বাবস্থায় নিয়ে ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরে, মাছের পেটের ভেতর থেকে ইউনুস (আ.)-কে উদ্ধার করে এবং আবাবিল পাখির দ্বারা আবরাহা আল হাবশীর হাত থেকে কা'বা ঘরের পবিত্রতা রক্ষা করে স্রষ্টা নিঃসন্দেহে প্রকৃতির উপর হস্ত ক্ষেপসহ সীমালঙ্ঘনকারীর শাস্তি দিয়েছিলেন। 

স্রষ্টা তার সৃষ্টিকর্মের উপর এ রকম হস্তক্ষেপ কখন করেন? যখন কেউ সীমালঙ্ঘন করে ফেলে তখন। কারণ পবিত্র কোরআনুল মজিদের সুরাতু আল বাকারা-এর ১৯০ নং আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন 'আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) তাঁর 'কোরানসূত্র' গ্রন্থের ৬৩৮-৬৪৭ নং পৃষ্ঠায় ‘সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদী' সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি পবিত্র কোরআন থেকে গোটা ত্রিশেক সূরার শতাধিক আয়াতের উদ্ধৃতিসহ যুগে যুগে সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ কিভাবে চরম শাস্তি দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, 'আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালঙ্ঘন করার জন্য শাস্তি দিতেন তবে পৃথিবীতে কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর যখন তাদের সময় আসে তখন তারা মুহূর্তকাল দেরি বা তাড়াহুড়ো করতে পারে না।'

এ বিধান শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, সীমালঙ্ঘনকারী কোনো ধর্মের কোপানল থেকেই রক্ষা পায় না। গল্প, উপমা ও দৃষ্টান্তের দ্বারা সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণাম সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। বনের সাধুবাবা ও তাঁর পোষা অসহায় মূষিক ছানার গল্প কে না জানে! সাধুবাবা গুহার অসহায় মূষিক ছানাকে পর্যায়ক্রমিক রূপান্তরের দ্বারা বনের শার্দুলে পরিণত করে দিয়েছিলেন। বনের সবচেয়ে অসহায় মূষিক একদিকে বনের রাজা আর অপরদিকে গাভরা শক্তির মালিকানা পেয়ে অহংকারে ভুলে যায় সাধু বাবার কাছে তার পুরানো ঋণের হিসাবনিকাশের কথা। অহংকারী শার্দুল একদিন হালুম করে আক্রমণ করে বসে তার স্রষ্টা সাধুবাবাকে। আর যায় কোথায়! সাধুবাবা ‘পুনমূষিকোভব’ বলতেই পরাক্রমশালী বনের শার্দুল আবার গুহার মূষিকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পাশেই বসা ছিল সাধুবাবার পোষা বিড়ালটা। সাধুবাবার সামনে থাকা মূষিককে খপ্ করে মুখে তুলে গজগমনে আড়ালে চলে গেল।

দেড় হাজার বছর আগের আইয়ামে জাহেলিয়ার (ঘোর অন্ধকার সময়ের) ক্ষুধার্ত ও ঘৃণিত আরব আজ যার দয়ায় ও উপলক্ষে ঐশ্বর্যের, শ্রদ্ধার ও ভালবাসার আরবে পরিণত হয়েছে তাঁর প্রতি কোনো অবহেলা কিংবা তাঁর পরবর্তী বংশানুক্রমের উপর কোনো রকম জুলুম, অত্যাচার ও অবিচার সীমা ছাড়িয়ে গেলে আল্লাহ বরদাশত করবেন না।

আইয়ামে জাহেলিয়ার প্রেতাত্মারা আরবের মাটি থেকে বিলীন হয়ে গেলেও একবারে বিলোপ হয়ে যায়নি। এরা অবস্থান পরিবর্তন করে সদর থেকে অন্দরে এবং দৃশ্য থেকে অদৃশ্যে কানামাছি খেলায় রত আছে। এদের ছোঁয়ায় তলিয়ে গিয়েছে উমাইয়া, আব্বাসীয়াসহ তুর্কী তখততাউস। জাহেলিয়ার প্রেতাত্মারা যে অপর কাউকে ছুঁতে পারবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে! (সমাপ্ত)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক