জুলাই সনদ বাস্তবায়ন
মধ্য নভেম্বরে গণভোটের আদেশ জারির প্রস্তুতি
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে খসড়া উত্থাপনের সম্ভাবনা
চলতি মাসের মধ্যভাগেই ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ–২০২৫’ জারি করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে সরকার নিজ সিদ্ধান্তেই আদেশ জারি করবে— এমন প্রস্তুতি এখন প্রায় চূড়ান্ত।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি খসড়া আদেশ ইতোমধ্যে চূড়ান্তকরণের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ খসড়া উত্থাপন করা হতে পারে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে।
গণভোটের সময় নির্ধারণ করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ সংক্রান্ত প্রাথমিক আলোচনায় উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান দায়িত্বে রয়েছেন।
এর আগে গত সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানানো হয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সাত দিনের মধ্যে সমঝোতা প্রস্তাব দিতে। কিন্তু রোববার (৯ নভেম্বর) সে সময়সীমা শেষ হলেও কোনো দল আলোচনায় বসেনি।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির জানিয়েছেন,
রাজনৈতিক সমঝোতা না হলেও সরকার পিছপা হবে না। সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। সম্ভবত চলতি মাসের মাঝামাঝি আদেশ জারি হবে।
রাজনৈতিক সমঝোতায় স্থবিরতা
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মূল পথ হবে গণভোটের মাধ্যমে। তবে, আদেশ কে জারি করবে এবং গণভোট কবে হবে— এ দুটি প্রশ্ন কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোটে সনদ অনুমোদিত হলে সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠিত হবে, যা ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে।
কিন্তু, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য দল এ প্রক্রিয়ায় একমত নয়।
বিএনপি চায় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণভোট হোক এবং সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত রাখার সুযোগ দেয়া হোক।
জামায়াত ও এনসিপি এর বিরোধিতা করছে। তাদের দাবি— নোট অব ডিসেন্ট ছাড়া গণভোট হওয়া উচিত, যাতে সংবিধান সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো বাধা দিতে না পারে।
জামায়াতসহ আটটি দল নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। মঙ্গলবার ঢাকায় তারা বড় জনসভা ও কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
গণভোট নিয়ে নতুন বিতর্ক
২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করেছিলো। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টের রায়ে সে অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়।
বিএনপি বলছে,গণভোট সাংবিধানিকভাবে এখনও অনিশ্চিত। নির্বাচনের পর সংসদে এটি সংযোজন করতে হবে।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ তাহের বলছেন, ১৯৭৭ সালে জিয়া ও ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া গণভোট করেছেন, এখন কেন নয়? নভেম্বরে নির্বাচনের আগেই গণভোট হতে হবে।
কে জারি করবে আদেশ?
জামায়াত ও এনসিপি মনে করছে, আদেশ জারি করতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে, রাষ্ট্রপতিকে নয়। তবে উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, আদেশ জারি হবে আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে।
ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম এবং পরে জিয়াউর রহমান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে থেকেও রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশ জারি করেছিলেন।
পটভূমি ও পরবর্তী ধাপ
১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরে ঘোষিত জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রস্তাবে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে— যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও উচ্চকক্ষ গঠনসংক্রান্ত ধারা উল্লেখযোগ্য।
জামায়াত ও এনসিপির আশঙ্কা, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে নিজেদের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে রূপান্তর করবে। তাই তারা চায় গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্তে যাওয়া হোক।
পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ
- গণভোট আদেশ: সম্ভবত ১৩–১৫ নভেম্বরের মধ্যে জারি হবে
- উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক: বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর)
- সমঝোতা সম্ভাবনা: ক্ষীণ
- রাজনৈতিক বিভাজন: বিএনপি বনাম জামায়াত–এনসিপি শিবিরে তীব্র মতভেদ
- সরকারের অবস্থান: আলোচনা নয়, সিদ্ধান্ত এখন সরকারের হাতে
অন্তর্বর্তী সরকারের এক সূত্র বলেছে,
গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে সরকারই আদেশ জারি করবে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে দেয়া হবে না। বিএনপি শেষ পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।
সবার দেশ/কেএম




























