ফাঁস হয়ে গেছে রহস্যজনক পরিকল্পনা
হাদিকে গুলির আগে ফয়সাল তার বান্ধবীকে দেন দেশ কাঁপানোর বার্তা
ঢাকার পল্টন এলাকায় জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবর্ষণের ঘটনায় নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। হত্যাচেষ্টার ঠিক আগের রাতে শুটার ফয়সাল তার কথিত বান্ধবীকে জানিয়ে দিয়েছিলো, পরদিন 'সারা দেশ কাঁপাবে' এমন একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ তথ্য গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ পেয়েছে, যা পুরো ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে জানা গেছে, এটি ছিলো একটি সুসংগঠিত গ্রুপের কাজ, যাতে অন্তত ২০ জন জড়িত ছিলো।
হত্যাচেষ্টার আগের রাতের রহস্য
শুক্রবার দুপুরে হাদির ওপর হামলার ঠিক আগের রাতে, বৃহস্পতিবার রাতে ফয়সাল এবং তার সহযোগী আলমগীর সাভারের গ্রিন জোন রিসোর্টের ২০৪ নম্বর রুমে ছিলো। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ফয়সালের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা। জিজ্ঞাসাবাদে মারিয়া স্বীকার করেছে, সে রাতে ফয়সাল মারিয়াকে বলে,
কাল (শুক্রবার) এমন কিছু হবে, সারা দেশ কাঁপবে।
পরদিন সকাল ৮টা ২৭ মিনিটে তারা রিসোর্ট ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসে। ফয়সাল মারিয়াকে ৩ হাজার টাকাও দিয়ে যায়। রিসোর্ট ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, 'সিয়াম' নামক কর্মচারীর মাধ্যমে তারা ৪ হাজার টাকায় রুম বুক করে। এ তথ্যগুলো গ্রেফতার আসামিদের রিমান্ডে ফাঁস হয়েছে।
সংগঠিত গ্রুপের জড়িতদের মুখোশ খুলছে
তদন্তে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের এক সাবেক কাউন্সিলর এ হত্যাচেষ্টার মাস্টারমাইন্ড। গ্রুপটি হত্যা, অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ, পলায়ন এবং সীমান্ত পারাপারে সহায়তা সরবরাহ করেছে। র্যাব ও পুলিশের অভিযানে এখন পর্যন্ত ৯ জন গ্রেফতার হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, মোটরসাইকেলের কথিত মালিক আবদুল হান্নান, সীমান্তে মানবপাচারকারী সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও, ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মো. কবির এবং তার বাবা-মা হুমায়ুন কবির ও মোসাম্মাৎ হাসি বেগম। গ্রেফতার কয়েকজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, যেমন আবদুল হান্নানকে ৫৪ ধারায় ৩ দিনের, সামিয়া, শিপু ও মারিয়াকে ৫ দিনের এবং কবিরকে ৭ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়।
উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র
আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে ফয়সালের বোনের বাসার নিচ থেকে ২টি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি, নরসিংদীর তরুয়া বিল থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ১টি খেলনা পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি। ফয়সালের বাসা থেকে কয়েক কোটি টাকার চেকও পাওয়া গেছে, যা মিশনের অর্থায়নের প্রমাণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তকারীরা বলছেন, হাদির হত্যায় কয়েক কোটি টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে।
পরিবার ও সহযোগীদের ভূমিকা
ঘটনার পর ফয়সাল ও আলমগীর আগারগাঁওয়ে তার বোনের বাসায় যায়। সেখানে বাবা হুমায়ুন কবির মোটরসাইকেলের ভুয়া নম্বরপ্লেট বদলে আসলটি লাগিয়ে দেন এবং পলায়নের জন্য গাড়ি ডেকে দেন। স্ত্রী সামিয়া ভাই শিপুকে দিয়ে বিকাশে ৪০ হাজার টাকা পাঠান, যদিও তিনি দাবি করেছেন হামলার কথা জানতেন না।
মোটরসাইকেলের নম্বরপ্লেট ছিলো ভুয়া, যা পরে বদলে ফেলা হয়। ফয়সালের ঘনিষ্ঠ কবির নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার। আদালতে তদন্তকর্তা বলেন, কবির আদাবর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। কবির দাবি করেছেন, মোটরসাইকেল তার বন্ধু মাইনুদ্দিনের নামে কেনা হয়েছে, তিনি শুধু উবার ড্রাইভার ছিলেন।
এছাড়া, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট যাওয়ার প্রাইভেট কারের চালক পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। তদন্তে জড়িত কর্মকর্তা বলেন, আরও শুটার গ্রুপ সক্রিয় থাকতে পারে বলে গোয়েন্দারা চৌকশ। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেছেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে মাস্টারমাইন্ড ও ভূমিকা জানার চেষ্টা চলছে। ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে ইনকিলাব মঞ্চের সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবেরের মামলা।
হাদির অবস্থা ও প্রেক্ষাপট
শুক্রবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটে বক্স কালভার্ট রোডে হাদিকে গুলি করা হয়। ঢামেকে সিটি স্ক্যান ও অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয় এবং রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একাধিক শুটার গ্রুপের উপস্থিতি নিয়ে সতর্ক।
সবার দেশ/কেএম




























