Sobar Desh | সবার দেশ মোঃ হাবিবুর রহমান


প্রকাশিত: ০০:২৬, ১৮ মে ২০২৫

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড: সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড: সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগটির নাম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড যা একটি দেশের জনসংখ্যাগত গঠনের এমন একটি পর্যায়, যেখানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি থাকে।

বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এখন তরুণ। এ তরুণ শক্তিই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনের মূল চালিকা শক্তি হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী?

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি ধাপ, যা ঘটে যখন একটি দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫–৬৪ বছর বয়সী) বৃদ্ধির হার নির্ভরশীল শিশু ও বৃদ্ধ জনগণের তুলনায় বেশি হয়। এসময় উৎপাদনশীল জনশক্তি বাড়ে, আয় বাড়ে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। তবে এ সুবিধা ভোগ করার সময় সীমিত। এটি একবারই আসে এবং এর জন্য চাই পরিকল্পিত উদ্যোগ।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখন কর্মক্ষম বয়সে রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে কয়েকটি প্রধান খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে:

১. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন:

বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন বিস্তার ঘটেছে, তেমনি মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক ও উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল হলেও পাঠদানের মান কম। সনদভিত্তিক শিক্ষা তরুণদের প্রকৃত কর্মদক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। ‘স্কিলস ফর টু ডে, জবস ফর টুমরো’ এ দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

আরও পড়ুন <<>> ক্লিন ইমেজের প্রার্থীর প্রশ্নে বিএনপির ভাবনা

২. কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন:

প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৮ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী চাকরি তৈরি হচ্ছে না। শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তা তৈরিতে উৎসাহ ও সহায়তা দিতে হবে। সরকার ও বেসরকারি খাতে স্টার্টআপ ইনকিউবেটর, সহজ ঋণপ্রাপ্তি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।

৩. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন:

বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও ডেটা অ্যানালিটিক্সের চাহিদা বাড়ছে। তরুণদের এ নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলা জরুরি। না হলে এ বিপ্লব আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

৪. সামাজিক বিনিয়োগ:

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোরিয়ার উদাহরণে দেখা যায়, সাংস্কৃতিক শিল্পকে তারা রপ্তানি পণ্যে রূপান্তর করেছে।  আমাদেরকেও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটিয়ে ‘সফট পাওয়ার’ বাড়াতে হবে। এতে তরুণরা সুস্থ ও সৃজনশীল থাকবে।

৫. নারীর অংশগ্রহণ:

নারীরা এখনও শ্রমবাজারে সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের পূর্ণ সম্ভাবনা পাওয়া সম্ভব নয়।

চ্যালেঞ্জ:

  • অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ: শিক্ষার মানহানি, কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্বল সরকারি সেবা কাঠামো।
  • নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা: দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব, তরুণদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা।
  • বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ: বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি।

করণীয়:

শিক্ষা ও শিল্পের সংযোগ বাড়ানো, জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন, প্রান্তিক ও গ্রামীণ তরুণদের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি সুযোগ, কিন্তু এর সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে তা অভিশাপেও পরিণত হতে পারে। কারণ বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেকার থাকলে সমাজে হতাশা, অপরাধ ও অসন্তোষ বাড়বে। তাই সময় এখনই যদি আমরা সাহসী পরিকল্পনা, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সঠিক বিনিয়োগ করতে পারি, তবে এ তরুণ শক্তিই আগামীর বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে পারবে।

লেখক: 
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সম্পর্কিত বিষয়: