তিন মাস পর তল্লাশিতে চাঞ্চল্য
বেনাপোলে আটক ভারতীয় ট্রাকে অবৈধ পণ্যের বিশাল ভাণ্ডার
দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলে তিন মাস ধরে আটক থাকা একটি সন্দেহজনক ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ ঘোষণাবহির্ভূত, কাগজপত্রবিহীন ও নিষিদ্ধ পণ্য উদ্ধার করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে ঘোষণার তুলনায় ট্রাকটিতে অর্ধেকেরও কম পণ্য পাওয়ায় বাকি পণ্য কোথায় গেলো—তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন, গুঞ্জন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে এ অভিযান।
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুর আনুমানিক ১টা ২০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত নিলাম প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বেনাপোল স্থলবন্দরে আটক ভারতীয় ট্রাকটির (নম্বর: এইচআর-৩৮-ইউ-২৪৮২) পণ্য পরীক্ষা করা হয়।
কাস্টমস সূত্র জানায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘রাইসা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল’ গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ট্রাকটি বেনাপোল বন্দর কার্গো টার্মিনালে প্রবেশ করায়। সে সময় গেট পাসে ২২৯ প্যাকেজ বডি স্প্রে আমদানির ঘোষণা দেয়া হলেও ট্রাকটি স্কেল কার্যক্রম সম্পন্ন না করে রাজস্ব ফাঁকির উদ্দেশ্যে পণ্য পাচারের চেষ্টা করে বলে সন্দেহ করা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ট্রাকটি আটক করে এবং পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেটি সিলগালা করে রাখে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক বা কোনও সিএন্ডএফ এজেন্ট পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল না করায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী ট্রাক বোঝাই পণ্য নিলামযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
সোমবার পরিচালিত তল্লাশিতে ঘোষণাকৃত বডি স্প্রের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অবৈধ ভারতীয় ওষুধ ও ওষুধ সামগ্রী, শাড়ি ও থ্রি-পিস, চাদর, জর্দা, আতশবাজি (পটকা), ফেসওয়াশ, ট্রিমারসহ বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক ও ভোগ্যপণ্য উদ্ধার করা হয়।
কাস্টমস সূত্র আরও জানায়, জব্দকৃত ওষুধ ও জর্দা বিধি অনুযায়ী ধ্বংস করা হবে। শাড়ি ও থ্রি-পিস প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে হস্তান্তর করা হবে এবং বডি স্প্রে ও ট্রিমার নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ট্রাকটিতে ঘোষণার তুলনায় প্রায় অর্ধেক পণ্য কম পাওয়া যাওয়ার বিষয়টি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিএন্ডএফ কর্মচারী জানান, ট্রাকটি প্রথমে সম্পূর্ণ পণ্যে ভর্তি ছিলো। ট্রাকের পেছনের দুইটি তালার স্থানে কাটার চিহ্ন এবং পুনরায় ঝালাই করার আলামত রয়েছে। তার দাবি, দীর্ঘদিন বন্দরে আটকে থাকার সুযোগে আমদানিকারকরাই অসদুপায়ে পণ্য বের করে নিয়ে আবার তালার স্থানে ঝালাই করে রেখেছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দফতরের একটি অংশের যোগসাজশ থাকার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
কাস্টমস সূত্র জানায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ট্রাকটি ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্গো ভেহিকেল ইয়ার্ডে প্রবেশের পরপরই গুঞ্জন ওঠে—ট্রাকটি রেখে চালক ও হেলপার ভারতে পালিয়ে গেছে। এতে শুরু থেকেই ট্রাকটিতে অবৈধ বা ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য থাকার সন্দেহ আরও জোরালো হয়। স্থানীয়দের প্রশ্ন, অবৈধ পণ্যের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার আশঙ্কাতেই কি তারা পালিয়ে যায়?
এদিকে, কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত বেনাপোলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরে কীভাবে কাগজপত্রবিহীন ও নিষিদ্ধ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করলো—তা নিয়েও উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। স্থানীয় আমদানি-রফতানিকারক ও সিএন্ডএফ সদস্যদের মতে, বিজিবি, বন্দর ও কাস্টমসের অনুমোদন ছাড়া কোনও ট্রাক বন্দরে ঢোকার সুযোগ নেই। তাহলে এ ট্রাকটি কীভাবে দেশে প্রবেশ করলো, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি।
এ বিষয়ে কাস্টমস কমিশনার খালেদ মোহাম্মাদ আবু হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া পণ্য তল্লাশি অভিযানে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমকে কোনও তথ্য না দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বেনাপোল বন্দর পরিচালক শামিম হোসেন বলেন, প্রায় তিন মাস আগে বন্দর কর্তৃপক্ষই ট্রাকটি আটক করে কাস্টমসকে অবহিত করেছে। ট্রাকে কী পণ্য রয়েছে এবং পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের।
উল্লেখ্য, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভুয়া বা জাল কাগজপত্রে ঘোষণাবহির্ভূত ও চোরাচালানি পণ্য আমদানির অভিযোগ নতুন নয়। এর ফলে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এর আগেও আমদানিকৃত পণ্যের আড়ালে ভারতীয় মদ, ফেনসিডিলসহ নানা নিষিদ্ধ পণ্য উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর থেকে ছাড়ের পর প্রায় আড়াই কোটি টাকার চোরাচালানি পণ্য আটক হওয়ার ঘটনায় বন্দরের দুইজন আনসার কমান্ডারের চাকরি হারানোর ঘটনাও আলোচনায় আসে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, কাস্টমস ও বন্দর সংশ্লিষ্টদের একটি অংশের যোগসাজশ ছাড়া এভাবে কাগজপত্রবিহীন পণ্য ট্রাকে করে দেশে প্রবেশ এবং দীর্ঘদিন বন্দরে আটকে থাকার সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়।
সবার দেশ/কেএম




























