আসন্ন নির্বাচন ও নাদান মুসলিম
‘ভাই, আমাদের আখেরাত তো এমনিতেই শেষ—আমাদের কি দুনিয়াদারীও করতে দেবেন না?’—জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে ফোন করে দেশের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার এই আক্ষেপমাখা বাক্যটি আজ বাংলাদেশি রাজনীতির নৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ মুসলিম। অথচ এ সমাজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন—সবই নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি অফিসে ঘুষ বাণিজ্য থামেনি, বরং বিদায়ী সরকারগুলোর তুলনায় বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কিছু দফতরে সেটি আরও গতি পেয়েছে—এমন অভিযোগ মানুষের মুখেই শোনা যায়। কারণ সরকার বদলালেও সচিবালয় ও মাঠপ্রশাসনে যারা পূর্বে এসব অনিয়ম চালাতো, তাদের বেশিরভাগই এখনও বহাল। তাদের কারও ভেতরে নৈতিক পরিবর্তন আসেনি, বরং নতুন ক্ষমতাবিন্যাসে তারা আরও সাহসী হয়েছে।
এ অবস্থায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন একেবারে দুয়ারে, তখন পুরনো ছবি আবারও ফিরে এসেছে। প্রার্থীরা ব্যানার–ফেস্টুনে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুড়ছেন, যেন নতুন কিছু হওয়ার অপেক্ষা নেই। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে চোখে পড়ছে দু’টি রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় উপস্থিতি—বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। উভয় দলই এবার দুর্নীতি দমনকে প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরেছে। জনসভা, সংবাদ সম্মেলন, টেলিভিশন টকশো—সব জায়গায় তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান ঘোষণা করছে।
এমন প্রেক্ষাপটে একটি ঘটনার উল্লেখ রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে দেশের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ফোন করে বলেছেন,
ভাই, আমাদের আখেরাত তো এমনিতেই শেষ, আমাদের কি দুনিয়াদারীও করতে দেবেন না?
এ বাক্য যেনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক নৈতিকতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। যারা জানেন কোন কাজ ইসলামে হারাম, জানেন আখেরাতে জবাবদিহি আছে—তারাই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধার লোভে স্বেচ্ছায় পাপকর্মকে নিয়মে পরিণত করেছেন। তারা জানেন দুর্নীতি ভুল, অন্যায় ভুল—তবু ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠতে পারলে তাদের কাছে সবই বৈধ।
আরও পড়ুন <<>> আইনের সঠিক প্রয়োগ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সহায়ক
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হযরত ওমর (রা.)–এর ন্যায়বিচার, রাসূল (সা.)–এর সততা ও চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত। রাসূলুল্লাহ (সা.)–কে এমনকি তার বিরোধী মুশরিকরাও ‘আল–আমিন’ উপাধি দিয়েছিলেন—বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের মুসলমানেরা আল্লাহ, বেহেশত–দোযখ, কোরআন–হাদিসে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী—কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবে সে বিশ্বাসের প্রতিফলন কোথায়? বিদেশের অমুসলিম সমাজেও যেখানে সততা, ন্যায়বোধ ও দায়িত্বশীলতা দেখা যায়, সেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বহু মানুষের আচরণ উল্টো চিত্র তুলে ধরে।
ক্ষমতার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য অনেক রাজনীতিক আজ নির্বাচনী প্রচারণায় যত না জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন, তার চেয়ে বেশি চেষ্টা করছেন অতীতের পাপকর্ম আড়াল বা বৈধতা দেয়ার। এ কারণেই দুর্নীতি বিরোধী অঙ্গীকার শুনে তারা আতঙ্কিত। কারণ দুর্নীতি তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বেরই অংশ। তাই তারা আক্ষেপ করে বলেন—আখেরাত তো গেলো, অন্তত দুনিয়াটা করতে দেন!
এ মনোভাবই আমাদের মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বড় সংকট। মুসলিম হয়ে কোরআন–হাদিস জানি, জানি অন্যায় করলে শাস্তি আছে; তবু রাষ্ট্রক্ষমতার মোহে মিথ্যাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, অবিচার—সবই করি নির্দ্বিধায়। শুধু সংসদ সদস্য হওয়ার জন্যই অনেকেই নিজের পরকালকে তুচ্ছ করে দেখেন।
এ চিন্তা, এ নৈতিক অবক্ষয় মুসলিম উম্মাহকে ‘নাদান’ ছাড়া আর কিছুই বানাচ্ছে না। যারা দুনিয়ার সাময়িক ক্ষমতার জন্য আখেরাত বিসর্জন দেন, তারা নিঃসন্দেহে পোড়া কপালের অধিকারী।
লেখক:
এম এম এ শাহজাহান, প্রকৌশলী
মার্কেটিং অ্যাডভাইজার, ফাইন গ্রুপ।




























