জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মুখ’ থেকে নির্বাচনী প্রার্থী
যেভাবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ওসমান হাদি
জুলাই বিপ্লবী ওসমান হাদি আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন ভাই ওমর হাদি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে নামটি দ্রুত আলোচিত-সমালোচিত হয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে এসেছিলো, তিনি ছিলেন সে ওসমান শরিফ ওসমান হাদি—সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় মুখ, তীব্র ভাষার বক্তা এবং পরবর্তী নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী।
শিক্ষক থেকে ‘জুলাই অগ্রনায়ক’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন হাদি। পাশাপাশি ইংরেজি শেখানোর একটি কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। মূল পেশা ছিলো শিক্ষা, কিন্তু আগ্রহ ছিলো সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে।
বরিশালের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থেকে উঠে আসা হাদি আলিম পাস করেন স্থানীয় এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে। রাজনীতির মাঠে তার সক্রিয় উপস্থিতি ছিলো না—২০২৪ সালের জুলাইয়ের অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থানই তাকে সামনে নিয়ে আসে।
জুলাই অভ্যুত্থানে উঠে আসা
২০২৪ সালের জুলাইয়ের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি, শাসন পরিবর্তন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সময় তিনি বিভিন্ন ভূমিকায় আলোচনায় আসেন। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে, বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইস্যুতে তার অবস্থান ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ-উত্তেজনাপূর্ণ। বঙ্গভবনের সামনে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ, ধানমণ্ডি ৩২ এ ভাঙচুরের সময় তার সক্রিয় উপস্থিতি তাকে সরাসরি আলোচনার মাঝে তোলে।
‘ইনকিলাব মঞ্চ’ এবং রাজনীতির শক্ত কেন্দ্র
জুলাই উত্তাল সময়ের পর তিনি ঘোষণা দেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’—একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের। লক্ষ্য ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, আহত-নিহতদের স্বীকৃতি ও বিচার, অপরাধীদের জবাবদিহি এবং তথাকথিত ‘জুলাই চার্টার’ ঘোষণার দাবি। ক্রমে প্ল্যাটফর্ম, সভা-সমাবেশ এবং ইস্যুভিত্তিক বক্তব্য তাকে নতুন রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
ইনকিলাব মঞ্চের মূল স্লোগান ছিলো আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ। এ বক্তব্য আওয়ামী লীগ-বিরোধী এবং ভারত-বিরোধী প্রবণতার ভোটারদের মধ্যে সমর্থন জোগায়। একইসঙ্গে এটি তাকে প্রতিপক্ষের টার্গেটে পরিণত করে।
‘হুমকি পাচ্ছি’, ‘আমাকে মেরে ফেলতে চায়’—বিতর্ক ও অভিযোগ
নানা সময় তিনি দাবি করেছেন, কমপক্ষে ৩০টি দেশি-বিদেশি নম্বর থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ করেছেন, তার বাড়িতে আগুন দেয়ার চেষ্টা হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনকে ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ তাকে একদিকে সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে সৃষ্টি করেছে সন্দেহ ও বিতর্ক।
সমালোচনা-প্রশংসা দুই দিকেই
হাদি আওয়ামী লীগ-বিরোধী অবস্থানের পাশাপাশি বিএনপির নেতাদের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেছেন—যা তাকে ‘আদর্শিকভাবে নিরপেক্ষ কিন্তু সংঘাতপূর্ণ’ রাজনীতির মঞ্চে ঠেলে দেয়। নির্বাচনমুখী প্রচারণায় ‘মুড়ি-বাতাসা’ বিতরণ করে সমর্থক টানার কৌশল নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে হাসাহাসি-সমালোচনা হয়েছে।
ঢাকা-৮ আসন (মতিঝিল, পল্টন, রমনা, শাহজাহানপুর) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দেন তিনি। প্রচারণার ভিডিও তিনি নিজেই ছড়িয়ে দিতেন। এক ভিডিওতে দেখা যায়, প্রচারণার সময় একজন তার পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন—যা রাতারাতি ভাইরাল হয় এবং নোংরা রাজনীতি বনাম সহানুভূতি নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে। ভোররাতে মসজিদের সামনে লিফলেট বিতরণ, রাত্রিবেলায় ইশতেহার ঘোষণা, ডোনেশনের মাধ্যমে প্রচার তহবিল সংগ্রহ—সবই ছিলো তার রাজনৈতিক উদ্যমের অঙ্গ।
হামলা, প্রশ্ন এবং মৃত্যু
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেল আরোহীদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। গুলি তার মাথায় লাগে। এরপর ঢাকা মেডিকেল, এভারকেয়ার ও পরিশেষে সিঙ্গাপুর—এক দীর্ঘ চিকিৎসা যাত্রার পর মৃত্যু।
এ মৃত্যু শুধু এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবসান নয়, বরং জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতির বিভাজন, সহিংসতা ও অস্থিরতার আরেক নির্মম প্রতিচ্ছবি হয়ে রইলো।
সবার দেশ/কেএম




























