রূপনগরে আগুনে স্বপ্নভাঙা আলো-জয়
বাবাকে শেষবার বলেছিলো— ‘আমরা আটকে গেছি’
‘কারখানায় আগুন লেগেছে, আমরা আটকে গেছি, বের হতে পারছি না’—বাবার সঙ্গে মোবাইল ফোনে এ ছিল ১৮ বছরের মার্জিয়া সুলতানা আলোর শেষ কথা।
তারপরও আরও দশ মিনিট ধরে ফোন বেজেছিলো, কিন্তু কেউ আর রিসিভ করেনি। তারপর থেকে ফোনটি বন্ধ—আর ফিরে আসেনি আলো কিংবা তার স্বামী জয়। পরাজয়ে অন্ধকারে পরাজয়ে ছেয়ে গেলো একটি পরিবার।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় ‘আরিয়ান ফ্যাশন’ নামে একটি পোশাক কারখানা ও পাশের কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে প্রাণ গেছে অন্তত ১৬ জনের। তাদের মধ্যে রয়েছে আলো-জয়ও, এমন আশঙ্কায় এখন ভেঙে পড়েছে দুই পরিবার।
নেত্রকোণার মদন উপজেলার ইয়াসমিন বেগম ঢাকায় এসে বসবাস করেন মজিবরের বস্তিতে, কারখানা থেকে মাত্র তিনশ গজ দূরে। মেয়ের সঙ্গে তার জামাতা জয়ও একই কারখানায় কাজ করতেন—জয় অপারেটর, আলো হেলপার।
ইয়াসমিন বললেন,
বিয়ের পর তারা এখানেই কাজ নেয়। আলোর বাবা সুলতান আগুনের খবর শুনে ফোন দিয়েছিলো, আলো রিসিভ করে শুধু বললো—বাবা, আমরা বের হতে পারছি না। তারপর আর কোনও শব্দ নেই।
জয়ের মা শিউলী বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
আমার ছেলে একটু ভালো থাকার আশায় এ গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিলো। এখন ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না, বউকেও না।

একই ফ্লোরে কাজ করতো ১৬ বছরের মুন্নী আক্তার। ছয় মাস আগে নাঈমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নাঈম মিষ্টির দোকানে কাজ করে, সংসারে অভাব অনটন। তাই মুন্নী সাড়ে সাত হাজার টাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। তার শাশুড়ি তাহেরা বেগম বলেন,
সকালে নাশতা খেয়ে কাজে গিয়েছিলো। বিকেলে শুনলাম আগুন লেগেছে। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুসারে, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে টিনশেড কেমিক্যাল গুদামে প্রথম আগুন লাগে, যা মুহূর্তেই পাশের চারতলা পোশাক কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট প্রায় ১২ ঘণ্টা চেষ্টা চালায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, টিনশেড গুদামে দাহ্য পদার্থ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখান থেকেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গার্মেন্টসে।
রাত সোয়া ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে উদ্ধার হওয়া ১৬টি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। লাশগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে স্বজনদের কান্না, আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিলো বাতাস। কারও হাতে মেয়ের ছবি, কারও হাতে জামাতার শার্ট—কেউই নিশ্চিত নন, তাদের প্রিয়জন এখনও বেঁচে আছে কিনা।
এক টুকরো স্বপ্নের জন্য আলো-জয়ের মতো শত শ্রমিক ঢাকায় আসে প্রতিদিন জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে আলো ছড়াবে সংসারে। কে জানতো পরাজয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে রূপনগরের আগুন, স্বপ্নগুলোকে ছাই করে দিবে এক বিকেলে।
সবার দেশ/কেএম




























