টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট
রায়ের দিন কোলকাতায় আওয়ামী কেন্দ্রীয় নেতাদের গোপন মিটিং
কলকাতায় গোপন বৈঠক–রায়ের দিন আওয়ামী কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘এক্সাইল’ মিটিং, জাতিসংঘ-অ্যামনেস্টির কড়া প্রতিক্রিয়া, দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে নতুন চাপ
ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে—ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার দিন কলকাতার এক গোপন স্থানে বৈঠকে বসেছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা।
বৈঠকের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা প্রকাশ না করলেও পত্রিকাটি জানায়, সেখান থেকে বাংলাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম—‘Awami leaders in exile plan stir in Bangla’।
সোমবারের (১৭ নভেম্বর) এ বৈঠকে উপস্থিত দলটির এক সিনিয়র নেতা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় আসলে আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। ৫ আগস্টের পর থেকেই তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। ক্ষমতাসীনরা এ মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়েছে বলে দাবি ওই নেতার।
এদিকে রায়ের খবর প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সারাদিন ধরে খবরের চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালগুলোতে আপডেট অনুসরণ করেন। পরে সন্ধ্যায় তিনি এক বিবৃতিতে আদালতের রায়কে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের নামে প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তার দাবি—শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই সাজানো অভিযোগে মামলা ও রায় দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, তার দল শিগগিরই ‘যমুনামুখী মার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসবে এবং আন্দোলন হবে কঠোর।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করার কারণেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে এ বিচার সাজানো হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাসিত নেতারা। তারা অভিযোগ করেন, হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে যেসব আইনজীবীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছিলো, কাউকেই আদালতে উপস্থিতের অনুমতি দেয়া হয়নি। তারা আরও প্রশ্ন তোলেন—কেন ও কী উদ্দেশ্যে এমন আদালত গঠন করা হলো?
জাতিসংঘের কঠোর বিবৃতি: মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত
রায়ের পর জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর (OHCHR) আবারও জানায়—যে পরিস্থিতিই হোক, তারা মৃত্যুদণ্ডের সম্পূর্ণ বিরোধী। সংস্থাটি বলে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র নেতৃত্বাধীন কোটা-বিরোধী আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতায় প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশু ছিলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। রায়কে তারা ‘ভুক্তভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যা দেয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফোলকার তুর্ক বলেন—তাদের সংগ্রহ করা সাক্ষ্য ও প্রমাণ রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই দায়ীদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানানো হচ্ছে।
অ্যামনেস্টির সমালোচনা: ‘বিচার হয়নি, হয়েছে ত্বরা ও অনিয়মের প্রদর্শনী’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ করেনি।
তার অভিযোগ—অনুপস্থিতিতে এ নজিরবিহীন দ্রুত বিচার এমন বড় ও জটিল মামলার ক্ষেত্রে গুরুতর অসঙ্গতি তৈরি করেছে। আদালতনিযুক্ত আইনজীবীকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সময় দেয়া হয়নি, পাশাপাশি পরস্পরবিরোধী প্রমাণ নিয়ে আসামিপক্ষকে জেরা করতে নিষেধ করা হয়েছে—যা বিচারকে আরও অনিয়মপূর্ণ করেছে।
ক্যালামার্ড বলেন—বাংলাদেশের প্রয়োজন এমন একটি বিচারব্যবস্থা, যা পুরোপুরি স্বাধীন, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং মানবাধিকারবিরোধী মৃত্যুদণ্ডকে ব্যবহার করে না।
দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে নতুন চাপ: টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয়
ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে—শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার গতি, অনুপস্থিতিতে বিচার ও ফলাফলের পূর্বনির্ধারণ যে ধারণা তৈরি করেছে তা বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাকে দুর্বল করতে পারে।
পত্রিকাটি সতর্ক করে বলে—ঢাকা রায় ঘোষণার পর ভারতকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে চাপ সৃষ্টি করেছে এবং হুমকিও দিয়েছে যে প্রত্যর্পণ না করলে তা ‘অবন্ধুসুলভ’ আচরণ হিসেবে দেখা হবে। এ অবস্থান দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে—ভারত বাংলাদেশের ‘মঙ্গলকামী’ এবং আলোচনায় প্রস্তুত। তবে বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনাকে ঘিরে সম্পর্ককে সংকুচিত করা দুই দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দিল্লি-ঢাকা ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ভর করবে—তারা কীভাবে এ মতপার্থক্য সামলে এগোতে পারে তার ওপর।
সবার দেশ/কেএম




























