স্বজনদের আহাজারিতে ভারী কবরস্থান প্রাঙ্গণ
জুলাই শহীদদের পরিচয় শনাক্তে লাশ উত্তোলন শুরু
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা নিহত ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে রায়েরবাজার কবরস্থানে লাশ উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডি।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে রোববার (৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় ৪ নম্বর ব্লক থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। স্বজনদের কান্না, আহাজারি আর দীর্ঘদিনের অপেক্ষা মিলিয়ে কবরস্থান প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে শোকভারাক্রান্ত।
লাশের সন্ধানে কবরস্থানে আসা অন্তত ১০টি পরিবারের মধ্যে ছিলেন নার্জিয়া ইসলাম নূপুর। স্বামী রফিকুল ইসলামের লাশের খোঁজে হলুদ বেষ্টনীর বাইরে বসে তিনি অঝোরে কেঁদে বলেন, তার স্বামী গত বছরের ১৯ জুলাই নামাজ পড়তে বের হয়ে নিখোঁজ হন। পরে এলাকার লোকজন জানান, মসজিদ থেকে বের হয়ে ডিম কিনছিলেন—সে সময় একদল লোক তাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে, আর পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যায়। দীর্ঘদিন থানাসহ কারাগার, হাসপাতাল, আদালত—সব জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও তার স্বামীর সন্ধান মেলেনি। বহু লাশের ছবি দেখে শনাক্ত করতে না পারলেও গত ৯ আগস্ট নার্জিয়া একটি ছবিতে স্বামীর বিকৃত লাশ চিনতে সক্ষম হন। পরে জানতে পারেন তাকে বেওয়ারিশ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই তিনি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসে কবরস্থানের প্রতিটি কাতার ঘুরে দেখেছেন স্বামীর সন্ধানে।
ছেলের ছবি হাতে হাজির হয়েছিলেন সোহেল রানার মা রাশেদা বেগমও। তার সন্তান ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই নিখোঁজ হন। তিনি বলেন, আমার ছেলে এখানেই আছে। ডিএনএ করুক, পোস্টমর্টেম করুক—আমি শুধু আমার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। বাবা লাল মিয়া জানান, তাদের ছেলের লাশ হাসপাতালে দেখে শনাক্ত করলেও ‘ওপর মহলের নিষেধাজ্ঞার’ কথা বলে লাশ দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত বেওয়ারিশ হিসেবেই দাফন করা হয়।
সোহেল রানা ও রফিকুল ইসলামের মতো আরও অন্তত ১০ পরিবার স্বজনদের সন্ধানে আবেদন করেছে। এর মধ্যে আছেন—ফেনীর টাইলস মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম (২৯), শেরপুরের গাড়িচালক আসাদুল্লাহ (৩১), ডেমরার আহমেদ জিলানী, ময়মনসিংহের মাহিম (২৫), কুমিল্লার ফয়সাল সরকার (২৫), চাঁদপুরের পারভেজ ব্যাপারী (২৩)–সহ অনেকেই।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ জানান, আন্তর্জাতিক প্রোটোকল অনুসরণ করে লাশ উত্তোলন, পোস্টমর্টেম, ডিএনএ স্যাম্পলিংসহ প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করা হবে। তিনি বলেন, যারা নাম-পরিচয়হীন অবস্থায় এখানে শুয়ে আছেন—তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা জাতির কাছে একটি দায়। এ কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর্জেন্টিনার আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফন্ডিব্রাইডার, যিনি গত ৪০ বছরে ৬৫টি দেশে একই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করেছেন।
তিনি আরও জানান, আবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ১১৪টি কবর চিহ্নিত হয়েছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা কমবেশি হতে পারে। লাশ উত্তোলনের পর বোন বা টিস্যু স্যাম্পল সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে এবং পরিচয় শনাক্ত হলে ধর্মীয় সম্মান বজায় রেখে পুনঃদাফন করা হবে। স্বজনরা চাইলে শনাক্তের পর লাশ গ্রহণ করতে পারবেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত লুইস ফন্ডিব্রাইডার বলেন, গত তিন মাস ধরে তিনি সিআইডির সঙ্গে কাজ করছেন এবং পুরো প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মানদণ্ড মেনে সম্পন্ন করা হবে। স্থানীয় সংস্থাকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তাও তিনি প্রদান করছেন।
স্বজনদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা, কান্না আর অসমাপ্ত প্রশ্নের ভিড়ের মাঝেই শুরু হলো পরিচয়হীন শহীদদের পরিচয় ফিরিয়ে দেয়ার ‘মহান কাজ’—যার মধ্য দিয়ে জাতীয় বেদনার বোঝা থেকে দেশ একসময় মুক্তি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবার দেশ/কেএম




























