নিষিদ্ধ বয়ান
জুলাইযোদ্ধাদের সুরক্ষা ছাড়া ইউনূসের সাফল্য ‘থ্রি জিরো’
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট—উভয়ই সামনে। কিন্তু দেশের মাঠে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটিকে নির্বাচনী উচ্ছ্বাস তো বলা যায়ই না, বরং সরাসরি ‘ভয়, রক্তাক্ত অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক আনমনে ওঠা-নামার এক নিঃশব্দ ভূকম্পন’ বলা চলে। বরিশালে এবি পার্টির সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ফুয়াদের ওপর বর্বর হামলা, আর ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ আসনের প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর অতি-প্রশিক্ষিত হামলাকারীর সুনির্দিষ্ট টার্গেট শট—এ দুই ঘটনার মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে দেশের রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নগ্ন রূপ।
এ হামলাগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কোনও আকস্মিক উত্তেজনার ফলও নয়। এগুলো স্পষ্টভাবে এক পরিকল্পিত হিংসাত্মক নীলনকশার অংশ—যেখানে লক্ষ্য একটাই: জুলাইযোদ্ধাদের নির্মূল, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা উন্মোচন এবং নির্বাচনকে অবিশ্বাসের অতল গহ্বরে ঠেলে দেয়া।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ: নিরাপত্তা নেই, রাষ্ট্রের প্রতিরোধ নেই
জুলাই আন্দোলনের সময় যে রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়েছিলো, যে আইনের শাসন পুরোপুরি ম্লান হয়েছিলো—সে বাস্তবতা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। দেশের প্রায় প্রতিটি থানায় হামলা হয়েছিলো। হাজার হাজার অস্ত্র লুট হয়েছিলো। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদে স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয়েছিলো দেড় হাজার মানুষ, ত্রিশ হাজার মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করেছে—এ বেদনায় এখনও জনমনে তীব্র ক্ষত। এরপর চৌদ্দ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে—সেসব লুট হওয়া অস্ত্র কোথায়? সে সন্ত্রাসীরা কোথায়? তারা সবাই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় জুলাইযোদ্ধাদের নিয়ে ক্রিটিক করছে, সুযোগ পেলে ফুয়াদ, ওসমান হাদিদের মেরে দিচ্ছে। ফুয়াদের ওপর হামলাকারীরা তো চিহ্নিত। হামলা করে পালিয়ে যায়নি। কিন্তু সরকার এবং সেনাবাহিনী নিস্ক্রিয়। তারা না কোনও সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করছে, না কোনও অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
ওপরের দু'টো ঘটনাই কোন দূর্ঘটনা নয়। সোজা সাপটা বললে এসব অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
তাহলে এখন নির্বাচন নির্বাচন নাটক মঞ্চস্থ করে সরকার কাকে খুশী করতে চাইছে?—প্রশ্ন দেশবাসির। সরকার কি কোনো সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে? সেনাবাহিনী কি কোনো কম্বিং অপারেশন করেছে? কোনো সন্ত্রাসী কি ধরা পড়েছে?
উত্তর—না।
তাহলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলা হবে কীভাবে? রাষ্ট্র মঞ্চ তৈরি করছে বটে, কিন্তু মঞ্চের সামনে অন্ধকারে লুকিয়ে আছে সশস্ত্র গোষ্ঠী, পুরোনো খুনি স্কোয়াড, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘাতকচক্র। হাদির মাথায় বুলেট ঢোকানোর ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আজকের হামলাকারীরা কারা? দুই চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো সে ‘নতুন ছদ্মবেশ সন্ত্রাসী’
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যারা দুপুরে মতিঝিলে হাদির জনসংযোগে মুখে মাস্ক পরে পাশে দাঁড়িয়েছিলো, তারাই কয়েক ঘণ্টা পর মোটরসাইকেলে এসে গুলি চালিয়ে পালিয়েছে। মানে—হামলাকারীরা শুধু প্রশিক্ষিত নয়, তারা হাদির প্রচারণা দলের ভেতরেও ঢুকে পড়েছিলো। এটা সংগঠিত রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা কি অন্তর্বর্তী সরকারের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নয়? এটা কি বিশুদ্ধ নিরাপত্তা বিপর্যয় নয়? এটা কি প্রমাণ নয় যে জুলাই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আজ সবচেয়ে বড় টার্গেটে?
সেনাবাহিনী কোথায়? নিরাপত্তা বেষ্টনী কোথায়? ‘জুলাইযোদ্ধা’রা কি শুধু পতন ঘটানোর জন্যই ছিলো?
জুলাইযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে স্বৈরাচারী ক্ষমতার পতন ঘটিয়েছে। তারা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেছে, বিএনপি–জামায়াতসহ অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কারামুক্ত করেছে—এ বাস্তবতা কোনও পক্ষই অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু আজ, সে একই জুলাইযোদ্ধারা ‘রাষ্ট্রের সবচেয়ে অরক্ষিত-অসহায় নাগরিক’ হিসেবে দিন কাটাচ্ছে।
তাদের বিরুদ্ধে হুমকি কারা দিচ্ছে?
- পতিত আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী।
- কিছু রাজনৈতিক দলের ভিতরকার সুবিধাবাদী গোষ্ঠী।
- দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্লিপার-সেল-
যারা জুলাইযোদ্ধাদের হত্যা করতে পারলে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে লাভবান হবে।
দেশবাসি গোপালগঞ্জের ঘটনা দেখেছে। তারা দেখেছে কীভাবে নিরস্ত্র ছেলেমেয়েরা আওয়ামী পেটুয়াদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। সে সময় সেনাবাহিনী প্রটোকল দিয়ে তাদের উদ্ধার করেছে—এটা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যখন আক্রমণ হয়েছিলো, তখন স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিলো? কেনো জুলাইযোদ্ধাদের গোপালগঞ্জ ঢোকার আগেই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়নি? রাষ্ট্র কি তাদের ‘রাজনৈতিক ইস্যু’ ভেবে দূরত্ব বজায় রেখেছে? না কি দুর্বৃত্তদের সঙ্গে কোনও গোপন সহাবস্থান তৈরি হয়েছে? এ প্রশ্নগুলো আজ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
সেনাবাহিনী তাদের প্রটোকল দিয়ে নিরাপদে ঢাকা নিয়ে আসে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই রাখে। তাছাড়া তারা একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা। সর্বোপরি তারা জুলাইযোদ্ধা—যাদের ওপর সর্বোচ্চ নাখোশ পতিত আওয়ামীলীগ। আওয়ামী লীগের রাজধানী খ্যাত গোপালগঞ্জে এ ছেলেমেয়েগুলো যাওয়ার আগেই সরকারের উচিত ছিলো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সেটা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অথচ সেখান থেকে সেনাবাহিনী তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার পর কিছু রাজনৈতিক দল ক্যালকুলেটর নিয়ে বসেছে রাষ্ট্র কতো খরচ করলো তাদের নিরাপত্তায়। এ ক্যালকুলেটর-বুদ্ধি ভুলে যায় ১৬ বছরের পতিত আওয়ামীলীগ কতো লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে। তাদের নিজেদেরও কেউ কেউ ব্যাংক, হাটবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য ভাগাভাগি করেছে আওয়ামী লুটেরাদের সঙ্গে।
জুলাইযোদ্ধারা আজ চারদিক থেকে টার্গেটেড: থ্রেট ম্যাট্রিক্স আরও ভয়ঙ্কর
বিএনপি–জামায়াতের শত্রু ছিলো একটাই—আওয়ামী লীগ। কিন্তু জুলাইযোদ্ধাদের শত্রু এখন আওয়ামী লীগ + বিএনপি + জামায়াত + বাম + স্লিপার নেটওয়ার্ক + প্রতিবেশি বিদেশপুষ্ট গোষ্ঠী। এদের চোখে জুলাইযোদ্ধারা হলো রাজনৈতিক অপ্রত্যাশিত ‘ফ্যাক্টর’—যাদের উপস্থিতি দেশের রাজনৈতিক জিওমেট্রি বদলে দিয়েছে। যাদের ত্যাগ এবং সাহস জুলাই সরকারকে আজকের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য—
এ জুলাইযোদ্ধারা এখন সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতায়।
হাসনাত, নাহিদ, সারজিস, জারা, সামান্তা, আখতার, হান্নান মাসউদ—এরা শুধু রাজনৈতিক কর্মী নন, এরা জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ। এদের কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো আন্দোলনের শিকড় কেঁপে ওঠবে।
ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য আছে, তবে নিরাপত্তায় ব্যর্থতা ভয়ংকর
ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্রের চাকা ঘোরানোর দায়িত্ব তার কাঁধে। কিন্তু তিনি একা—কোনও দল নেই, নিজের প্রশাসন নেই, উপদেষ্টা হিসেবে উপযুক্ত সক্রিয় শক্তি নেই। তা সত্ত্বেও তাকে এগোতে হবে। কারণ, নির্বাচনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব।
জুলাইযোদ্ধাদের ওপর হামলা মানে সরাসরি অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জ
হাদি আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে; তার ফিরে আসা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘মিরাকল’ ছাড়া কিছু নয়। এ অবস্থায় ড. ইউনূস যদি নিরাপত্তা–বিপর্যয় সামাল দিতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি যেসব ‘থ্রি জিরো’ স্বপ্নের কথা বলছেন—
- শূন্য দাঙ্গা
- শূন্য দুর্নীতি
- শূন্য দুঃশাসন—
সবই রূপ নেবে ‘শূন্য কার্যকারিতা’তে।
দেশবাসীর প্রশ্ন: কে দেবে আমাদের নিরাপত্তা? রাষ্ট্র কি শুধু পর্যবেক্ষক?
যখন দেশের নাগরিকেরা আতঙ্কে, যখন প্রতিটি স্বাধীন প্রার্থী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নিশানায়, তখন নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণায় মানুষের আগ্রহ নেই। মানুষ জানতে চায়—নির্বাচনের আগে অস্ত্রধারীদের ধরবেন কে? লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করবে কোন বাহিনী? যারা জুলাই আন্দোলনে খুনি স্কোয়াড পরিচালনা করেছে, তারা কি এখনও সক্রিয়?
হাদি কিংবা ফুয়াদের মতো আর কতজনকে হাসপাতালে পাঠালে নিরাপত্তা বাহিনীর ঘুম ভাঙবে?
আরও পড়ুন <<>> নীরব সমর্থকদের দল বিএনপি, নেতাকর্মীদের নয়!
রাষ্ট্রকে এখনই কঠোর হতে হবে—প্রয়োজনে ‘সন্ত্রাস দমন জরুরি অধ্যাদেশ’ জারি করতে হবে
যা এখন দরকার—
- রাজধানীসহ ৬৪ জেলায় অস্ত্র উদ্ধারে সামরিক-সহায়তায় সম্মিলিত অভিযান
- জুলাইযোদ্ধাদের জন্য ভিভিআইপি স্তরের নিরাপত্তা
- নির্বাচন–সম্পৃক্ত স্বাধীন প্রার্থীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা টাস্কফোর্স
- সিসিটিভির ভিডিও-ম্যাচিং টেকনোলজি দিয়ে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি
- রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনায় জিরো টলারেন্স
রাষ্ট্র এখন শক্ত অবস্থান না নিলে, নির্বাচন আর গণভোট—দুটিই বিশৃঙ্খলার চোরাবালিতে ডুবে যাবে।
শেষ কথা: ইউনূস সাহেব, এখনও সময় আছে—জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তা দিন, নইলে সব ব্যর্থ হবে
আপনি একা সরকার। আপনার কাঁধে দেশের লোকতান্ত্রিক প্রত্যাশার বোঝা। কিন্তু নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে আপনি এখন ব্যর্থতার কঠিন দেয়ালে ঠেকে আছেন—এ কথা বলতেই হবে। হাদি, ফুয়াদ, কিংবা আগামী দিনে যাদের টার্গেট করা হবে—তারা শুধু রাজনৈতিক কর্মী নন; তারা একটি নতুন বাংলাদেশের প্রতীক। তাদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব—
এটা দয়া নয়, দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হয়—তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিটি অর্জন, প্রতিটি সাফল্য, প্রতিটি সংস্কার—সবই টেনে নিয়ে যাবে একটাই গহ্বরের দিকে—
ব্যর্থতার ‘থ্রি জিরো’তে।
লেখক ও সংবাদকর্মী




























