ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: হেজমনি ভাঙনের গল্প
‘অপরাজেয়তা’ এখন প্রশ্নবিদ্ধ, প্রতিরোধে নতুন অধ্যায় লিখছে তেহরান
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শুধু গোলা-বারুদের লড়াই নয়—এটি বহু দশকের গড়ে ওঠা এক পক্ষের ‘অপরাজেয়তার’ মিথ ভাঙার বাস্তবতা। সাম্প্রতিক ইরানি পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের সবচেয়ে গর্বের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ কার্যত ধাক্কা খেয়েছে। হিজবুল্লাহ বা হামাসের রকেট ঠেকাতে সফল হলেও ইরানের কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে এর দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে করে শুধু সামরিক দিক নয়, আঞ্চলিক রাজনীতি, প্রোপাগান্ডা এবং মনস্তত্ত্বেও বড়সড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ইরান কীভাবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা দেয়ালে ফাটল ধরালো এবং কীভাবে এ ঘটনাপ্রবাহ একটি আঞ্চলিক হেজমনি ভাঙনের ইঙ্গিত বহন করে, তা নিয়েই এ বিশ্লেষণ।

আয়রন ডোমের বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে:
দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রতীক ছিলো ‘আয়রন ডোম’। দাবি করা হতো, এর ইন্টারসেপশন রেট ৯০% ছাড়িয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পর এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫%-এ। এ একটি পরিসংখ্যানই ‘অপরাজেয় ইসরায়েল’ ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে।
আর এটিই ছিলো ইরানি কৌশলের অন্যতম লক্ষ্য—শুধু টার্গেট নয়, মনস্তাত্ত্বিক ব্যূহ ভাঙা।
ভয়ের কৌশল ও হেজমনি ভাঙা:
ইসরায়েলের আঞ্চলিক আধিপত্য বহুদিন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো ‘ভয়ের ভারসাম্য’ এবং ‘ক্ষমতা প্রদর্শনের’ ওপর। স্কুল, হাসপাতাল, আবাসিক ভবনে দফায় দফায় হামলা চালিয়েও তারা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে। এ ছুট মাফিয়া-ধাঁচের ভাবমূর্তিকে ‘আনটাচেবল’ করে তুলেছিলো তাদের স্টেলথ এয়ারক্রাফট, মার্কিন সহায়তা ও ডোমিনেন্স ভিত্তিক ডিপ্লোমেসি।
কিন্তু ইরান সে ছক বদলে দিয়েছে—সরাসরি ফায়ারপাওয়ার দিয়ে নয়, বরং চাতুর্যপূর্ণ কৌশল দিয়ে।

তিন স্তরের জবাব দিয়েছে ইরান
- টেকনিক্যালভাবে: ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের যুগপৎ আক্রমণ এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে যাতে ইসরায়েল একসাথে প্রতিক্রিয়া জানাতে না পারে। টাইমিং ও স্পেসিং ছিলো অব্যর্থ।
- মনস্তাত্ত্বিকভাবে: তেলআবিবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ শেল্টারে, রাস্তা ফাঁকা। এক মুহূর্তে গাজার প্রতিচ্ছবি যেন উল্টে দিলো তেলআবিবের গর্বিত চেহারা। অর্থাৎ, তেলআবিবে গাজার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে পালানোর চিত্র সৃষ্টি করে।
- রাজনৈতিকভাবে: নেতানিয়াহু নিজেই বলেছেন—‘ইট ওয়াজ আ পেইনফুল লস’। এ স্বীকারোক্তিই ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজিক অহংকারে বড় আঘাত।

আয়রন ডোম: কমব্যাট প্রুভেন, কিন্তু সীমিত
হামাস বা হিজবুল্লাহর সাধারণ রকেট আটকাতে পারলেও ‘ম্যানুভারেবল, হাই-টেক মিসাইলের বিরুদ্ধে’ আইরন ডোমের কার্যকারিতা অনেকটাই সীমিত। সুতরাং এটি ‘কমব্যাট প্রুভেন’ হলেও প্রশ্ন থাকে: কার বিরুদ্ধে এবং কোন ধরনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে?

প্রোপাগান্ডা বনাম বাস্তবতা
ইসরায়েল যতোদিন মিডিয়া ব্যবহার করে নিজের 'অপরাজেয়' ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে, এখন ততটাই চেষ্টা করছে দুর্বলতা ঢাকতে।
প্রমাণ?
ইরানি হামলার ভিডিও প্রকাশে এখন ৩০ মাসের জেল শাস্তি। এ প্রোপাগান্ডা-নির্ভরতা এখন নিজেই পরিণত হয়েছে দুর্বলতায়।

ইরানের ক্ষতি ছিলো প্রত্যাশিত, ইসরায়েলের ছিলো প্রতীকী ধ্বস
ইরান জানতো তারা আর্থিক ও সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের কৌশল ছিলো—ধৈর্য ধরে আঘাত হানা। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি তাদের পুনরুদ্ধার করতে পারবে। কিন্তু ইসরায়েলের জন্য এ ক্ষতি ছিলো ‘অপ্রত্যাশিত’ এবং ‘সিম্বলিক শক’।
সবচেয়ে বড় বার্তা: ইসরায়েলকে আঘাত করা সম্ভব
এ বার্তাই এখন ছড়িয়ে পড়ছে পুরো মুসলিম বিশ্বে, বিশেষত আরব তরুণদের মধ্যে। ‘যাকে কেউ থামাতে পারে না’— এ চিত্রটা ভেঙে দিয়েছে ইরান। এটা শুধু সামরিক চ্যালেঞ্জ নয়—এটা একটি হেজমনিক ন্যারেটিভের ভাঙন।

ইসরায়েলকে আর ‘আনটাচেবল’ ভাবার দিন শেষ:
এখন যুদ্ধ শুধু গোলা-বারুদের খেলা নয়—এটা কৌশল, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি আর ‘আত্মবিশ্বাসের লড়াই’।
আর সে লড়াইয়ে, ইরান একাই নয়—তার সঙ্গে জেগে উঠেছে বহু শোষিত, নিপীড়িত অঞ্চলের চুপ থাকা জনতার স্রোত।
এ গল্প শুধু একটি সংঘাত নয়—এটি হেজমনি ভাঙনের গল্প।
সবার দেশ/কেএম




























