১৭ নভেম্বরে উত্থান–পতনের নিষ্ঠুর সমাপতন
হাসিনা ট্রাজেডি: দিল্লিতে শুরু, দিল্লিতেই পতন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্ক, ক্ষমতার নেশা, দমন-পীড়ন ও পাল্টা অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক খুনি হাসিনার জীবন যেনো এক অদ্ভুত রাজনৈতিক বৃত্ত—যার সূচনা যেমন হয়েছিলো ভারতে, পতনের সংবাদও তাকে পৌঁছেছে একই দেশ থেকে।
১৯৬৮ সালের ১৭ নভেম্বর ড. ওয়াজেদ মিয়াকে বিয়ে করেন শেখ হাসিনা। ঠিক এ তারিখেই ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে জুলাই গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—১৯৮১ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বসেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, এবং ৪৪ বছর পর আবার দিল্লিতেই বসেই নিজের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় শুনলেন।
পরিবারতন্ত্রের উত্তরাধিকারে উত্থান
শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় ও পরিবারতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের কারণেই জাতীয় রাজনীতিতে তেমন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন খুনি হাসিনা। তখন তিনি নির্বাসনে ভারতের দিল্লিতেই ছিলেন। দলের ভেতরেই তার নেতৃত্ব নিয়ে তীব্র বিরোধিতা ছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুজিব পরিবারের প্রতি আনুগত্যের চাপেই তিনি নেতৃত্বে আসীন হন।
১৭ মে দেশে ফিরে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। অভিযোগ—এর পর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগে একটি দৃঢ় বলয় তৈরি করেন, যেখানে ত্যাগী নেতাদের ধীরে ধীরে কোণঠাসা করা হয়। স্বাধীনতার পর সংকটময় সময়ে দলের হাল ধরা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন থেকে শুরু করে ড. কামাল হোসেন—অনেক অভিজ্ঞ নেতাই তার রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে চলে যান বা অপমানিত হয়ে দল ছাড়েন।
রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ও ক্ষমতার পথে বিতর্ক
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুললেও ১৯৮৬ সালে হঠাৎই সেনাশাসক এরশাদের নির্বাচনে অংশ নেন হাসিনা। পরে গণআন্দোলনের চাপ বাড়লে তিনি আবার আগের মিত্রদের সঙ্গে জোট বাঁধেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর তিনি ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলেন, যদিও দলটির তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ড. কামাল হোসেনসহ আন্তর্জাতিক মহল সে নির্বাচনকে দেশের অন্যতম সুষ্ঠু নির্বাচন বলে অভিহিত করেছিলো।
বিচারিক হত্যা, রাজনৈতিক দমন–পীড়ন ও ক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ
২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন, যা নিয়ে দেশি–বিদেশি মহলে প্রশ্ন ও বিতর্ক ছিলো। জামায়াতের শীর্ষ ছয় নেতা এবং বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ‘বিচারিক হত্যা’ ও ‘নাটকীয় বিচার’—এমন অভিযোগ উঠেছিলো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, পরপর তিনবার একতরফা নির্বাচন—এসবের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিরোধী দল, সংসদীয় রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন তিনি।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সংবাদমাধ্যম আইন ব্যবহার করে সমালোচনা দমন, সাংবাদিক গ্রেফতার এবং ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি—এসব ছিলো তার শাসনামলের প্রধান অভিযোগ।
শেষ পরিণতি: ছাত্র আন্দোলনে পতন, পালিয়ে যাওয়া এবং রায়
২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে সরকারের ভয়ঙ্কর দমন–পীড়নে এটি রূপ নেয় ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান প্রায় ১৪০০+ মানুষ। অবশেষে ৫ আগস্ট জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বোন রেহানাকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান।
এরপরই ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় এবং জুলাই গণহত্যার বিচার শুরু হয়। হাসিনা দেশে না থাকলেও তার গঠিত ট্রাইব্যুনালই—১৫ মাস পর—জুলাই গণহত্যার প্রথম মামলায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়।
হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা পালিয়ে যান বা গ্রেফতার হন। বিক্ষুব্ধ জনতাও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে। দানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি–ম্যুরাল ধ্বংস, দলের কার্যালয় ভাঙচুর এবং ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
দিল্লিতে শুরু, দিল্লিতে সমাপ্তি
একজন গৃহবধূ থেকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের জোরে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেত্রী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার রাজনীতির শুরু হয়েছিলো দিল্লি থেকে। আর গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সংবাদও পৌঁছালো সে দিল্লিতেই—যেখানে তিনি এখনও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সুরক্ষায় অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসনকাল শেষে তার পতন যেমন ছিলো নাটকীয়, বিচারিক রায়ও তেমনি ঘটলো তার রাজনৈতিক বাঁকের দিন—১৭ নভেম্বরেই।
সবার দেশ/কেএম




























