গণভোটে নির্ধারিত চার প্রশ্ন
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গেজেট প্রকাশ
অবশেষে প্রকাশিত হলো বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে সরকারিভাবে এ গেজেট জারি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ঘোষিত জাতীয় সংস্কার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের পথে আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটলো।
এর আগে উপদেষ্টা পরিষদ আদেশটির খসড়া অনুমোদন দেয় এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠানোর আগে এর সারসংক্ষেপে স্বাক্ষর করেন।
পটভূমি: গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কারের সূত্রপাত
গেজেটের ভূমিকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। সে অভ্যুত্থানের ফলেই ৫ আগস্ট তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়, ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয় এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়—যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্কারের লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কাঠামো সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে। এসব কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়।
পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল ও গণআন্দোলনের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়ন করে, যেখানে সব দল একযোগে স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে।
আদেশের মূল বক্তব্য
রাষ্ট্রপতির জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত জুলাই সনদের প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। এ আদেশের কিছু ধারা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে, বাকিগুলো গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট পাওয়া সাপেক্ষে কার্যকর হবে।
গণভোটের সঙ্গে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
গণভোটে ভোটারদের সামনে চারটি প্রশ্ন
গণভোটের ব্যালটে ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবেন নিম্নলিখিত চারটি প্রশ্নে—
- নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় গঠন করা হবে কি না।
- জাতীয় সংসদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট হবে কি না—যেখানে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য ওই কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদন লাগবে।
- সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ নিশ্চিতকরণ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ ৩০টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
- জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারগুলো দলগুলোর অঙ্গীকার অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে কি না।
গণভোটের ফল ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ
গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। সংসদ সদস্যরাই একযোগে পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই সনদ ও গণভোটের ফল অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে।
পরিষদের সভাপ্রধান ও উপ-সভাপ্রধান প্রথম অধিবেশনের শুরুতেই নির্বাচিত হবেন। কোরাম পূর্ণ করতে কমপক্ষে ৬০ সদস্য উপস্থিত থাকতে হবে এবং সমসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্রে সভাপ্রধানের ভোট হবে নির্ণায়ক।
পরিষদের সদস্যদের সংসদ সদস্যদের মতোই বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি থাকবে।
উচ্চকক্ষ গঠন ও কার্যকারিতা
সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এর মেয়াদ নিম্নকক্ষের মেয়াদের সমান হবে। উচ্চকক্ষের কার্যপ্রণালী নির্ধারণ ও সম্ভাব্য বাধা দূর করতে পরিষদ ও সরকার প্রয়োজনীয় বিধান ও নির্দেশনা জারি করতে পারবে।
সংবিধান সংশোধন প্রকাশ ও কার্যকর
পরিষদের গৃহীত সংবিধান সংস্কারই হবে চূড়ান্ত। এ বিষয়ে অন্য কোনো অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না। পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ পাঠ সরকার গেজেটে প্রকাশ করবে এবং যেসব পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব সেগুলো অবিলম্বে কার্যকর করা হবে।
শপথ ও প্রশাসনিক কাঠামো
সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানের সময়ই তারা পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। জাতীয় সংসদ সচিবালয় পরিষদের প্রশাসনিক ও সাচিবিক সহায়তা দেবে।
সরকারের ক্ষমতা ও নির্দেশনা
গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। পাশাপাশি এই আদেশের বিধান বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনে বিশেষ নির্দেশনাও দিতে পারবে।
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের যে প্রতিশ্রুতি জুলাই সনদে দেয়া হয়েছিলো, সে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন শুরু হলো এ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে।
সবার দেশ/কেএম




























